This video chronicles my journey to find out about Sridhara, the mathematician with video/audio clips of the places I visited, books I read, and the people I talked with. This is not the end of the journey. This is just the beginning!
(১)
শ্রীধর আচার্য সম্পর্কে প্রথম শুনি স্কুলজীবনে। অজিতবাবুর কাছে। অজিতবাবু অঙ্কের শিক্ষক। বেশ রাশভারী ধরনের মানুষ। মাথার দুই তৃতীয়াংশ টাক। যেটুকু চুল ছিল তা মাথার পরিসীমা জুড়ে বীজগণিতের কোন কঠিন সূত্রের মত বিন্যস্ত। স্কুলের ছেলেরা ওনাকে 'এইচ টু এস ও ফোর' বলে রাগাত। সালফিউরিক অ্যাসিডের ফর্মুলা। কেন তিনি এই অ্যাসিডের ফর্মুলা শুনলে রেগে যেতেন তা আমার কাছে আজো রহস্য। অজিতবাবু নিজের ছেলের খুব গর্ব করতেন। ছেলে নাকি সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন। এত বড় চাকরি যে - 'সুইচ টিপলেই চা'। এখানে তিনি চা বানানোর যন্ত্রের কথা বলতেন নাকি চা বানানোর জন্য কোন বেয়ারা ছিল, সে ব্যাপারে ছাত্রমহলে যথেষ্ট অনুসন্ধিৎসা ছিল।
যাইহোক, এতদিন পরে লিখতে বসেছি অজিতবাবুকে নিয়ে নয়। তাকে নিয়ে পরে কিছু লেখা যেতে পারে। তবে আজ শ্রীধর আচার্যের কথা বলব। সেই স্কুলের অজিত বাবু, ত্রিকোণমিতি, আর শ্রীধর আচার্যের দ্বিঘাত সমীকরণের সূত্র পেরিয়ে জীবন অনেক দূর গড়িয়ে এসেছে। পি এইচ ডি, বিদেশ, বিবাহ, সন্তান ইত্যাদি জীবনের মাইলফলক গুলো কখন পার করে এসেছি তেমন ভাবে টের পাই নি। যেন কোন পুরনো হার্ড ড্রাইভে বন্দী হয়ে আছে।
কয়েকমাস আগে একটি পত্রিকায় এক ফরাসী গণিতজ্ঞ নিয়ে লিখছিলাম। মসিয়ে ফার্মা। ফার্মা সাহেবের অদ্ভুত এক দোষ ছিল। তিনি তাঁর বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে কঠিন কঠিন সব উপপাদ্য লিখে রাখতেন। কিন্তু উপপাদ্যগুলির প্রমাণ লিখে রাখতেন না। বলতেন - এসব প্রমাণ সহজেই করা যায়। এরকই একটি উপপাদ্যের প্রমাণ করতে পৃথিবীর তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদেরও প্রায় দুশো বছর লেগে গিয়েছিল। এই সব কাহিনীই লিখছিলাম। লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে হল - আচ্ছা ফরাসী গণিতজ্ঞ নিয়ে লিখছি, ভালো কথা। কিন্তু আমাদের দেশেও তো বহু পণ্ডিত মানুষ জন্মেছেন, তাদের কজনকেই বা আমরা ভালো করে জানি। আর্যভট্ট, চাণক্য, ভাস্কর, ব্রহ্মগুপ্ত, নাগার্জুন, কৌটিল্য এইসব কিছু নাম আমরা শুনে থাকব। কিন্তু তার পরেও অনেক পণ্ডিত মানুষ ছিলেন যারা ইতিহাসের পাতা থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। বিস্মৃতির কোন এক অতল গহ্বরে। তাদেরকে সম্পর্কে কি আর কিছুই জানা যায় না? মনে হল এইসব ইতিহাস খুঁড়ে বার করা উচিত। যে জাতির কোন ইতিহাস নেই, তার কোনও ভবিষ্যৎও নেই যে!
তখন শ্রীধর ভট্টের নামটা মাথায় এলো। মানুষটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। যতটুকু জানা যায় তার মধ্যেও আবার বিতর্ক আছে। তিনি নাকি জন্মেছিলাম অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। প্রাচীন বাংলার 'ভূরিশ্রেষ্ঠ' নামক গ্রামে। সেই গ্রাম পরে 'ভূরসুট' নামে পরিচিত হয়। উইকিপিডিয়ায় ওনাকে নিয়ে সিকি পেজ একটা বিবরণ আছে। কোন এক ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ওনাকে নিয়ে কিছু লিখেছেন। ১৯৬০-৭০ সালে শ্রীধর আচার্যকে নিয়ে কিছু গবেষণাপত্র, থিসিসও লেখা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। উনি বাংলার মানুষ নাকি দক্ষিণ ভারতের সেই নিয়েও ঐতিহাসিক মহলে বেশ জল ঘোলা রয়েছে।
পড়াশোনা করে জানলাম যে ভূরসুট গ্রামটি অধুনা হুগলী-হাওড়ার অন্তর্গত হতে পারে। ঘটনাচক্রে আমিও হুগলীর লোক। তাই ভাবলাম এইবার যখন দেশে ফিরব ওনার সম্পর্কে কিছু তথ্যসংগ্রহ করব। সম্ভব হলে একটা বই লিখব। সত্যি কথা বলতে কি ব্যাপারটা আমার বেশ রোমাঞ্চকর লাগছিল। কবেকার অষ্টম-নবম শতাব্দীর কোন প্রাচীন আচার্য। না জানি তখন কেমন ছিল গ্রাম বাংলা। কেমন ছিল প্রাচীন জনপদ। ছোটবেলা থেকে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শঙ্কু, শার্লক হোমস পড়ে মানুষ হয়েছি। রসায়নের জটিল কিছু মেকানিজমের কথা বাদ দিলে গোয়েন্দামূলক কাজ সেরকম কিছু করিনি। তাই নিজেকে বেশ ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আচার্য সম্পর্কে প্রথম খেইটা পেলাম সেদিন রাত্রে। পরের দিনই বাইকটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
সময়টা অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি। মাঠে মাঠে আলুচাষিদের ভিড়। আলু বসানো চলছে। এখানের চাষিদের আলুর উপর নির্ভর। কোন কোন বছর চাষিরা ভালো দাম পায়। কোন কোন বছর পায় না। যেন লটারি। কে জানে এ বছর লটারি লাগবে কিনা। আলু বসানো চলছে মানে ধান কাটা হয়ে গেছে। এবারে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। মাঠ ধু ধু করছে। আজ আকাশটা বেশ মেঘলা ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। তবুও ভাবলাম বেড়িয়ে পড়ি। বাইকে করে গেলে আধা ঘণ্টার রাস্তা। ডিহিভূরসূট গ্রাম।
আচার্য সম্পর্কে আমায় সন্ধানটা দিয়েছিল দীপুদা। দীপুদা আমার এলাকার মানুষ। এই অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছে। আমার সাথে জানা শোনা অনেকদিনের। ওর ভাই সুদীপ্ত বাঁকুড়ার কোন এক জায়গার বিডিও ছিলেন। রাঢ় এলাকার মানুষ এবং তাদের ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন সুদীপ্ত। সেদিন আমি দীপুদাকে ফোন করলাম। বললাম - 'শ্রীধর আচার্য সম্পর্কে একটা বই লিখছি। তুমি জানো ওনার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু? আমি যতদূর জেনেছি, তিনি নাকি এখানকার লোক ছিলেন।' দীপুদা বলল - 'শ্রীধর আচার্যের বাড়ি হুগলীতে? কই জানি না তো! ছোটবেলায় ওনার দ্বিঘাত সমীকরণের সূত্র পড়েছিলাম। কিন্তু তার বেশি কিছু জানি না। মানুষ কি আর মনে রাখে অতদিন আগেকার কথা? কবেকার অষ্টম-নবম শতাব্দীর ব্যাপার! আচ্ছা আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।'
আমার খুব একটা আশা ছিল না। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে পরের দিনই দীপুদার ফোন পেলাম। খোঁজ মিলেছে। পাশেই ডিহিভুরসুট গ্রামে একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি আছে। সেটা নাকি আচার্যের বংশধররা কোন এক কালে বসবাস করতেন। সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান। পুকুর। তবে এখন সেখানে জনপ্রাণী বলতে কেউ নেই। সবই জঙ্গলে ভর্তি হয়ে গেছে। গ্রামের সবাই বলে সেখানে নাকি ভুতেদের আখড়া। সন্ধ্যার পর আর কেউ পা মাড়ায় না। সে যাইহোক, আমি এই খবরটুকু পেয়ে স্বভাবতই খুব আপ্লুত হলাম। ভাবলাম কালই রওনা দেব। দেখে আসব জায়গটা একবার।
সেই রাতে উত্তেজনায় ভালো করে ঘুম হল না। অচল ভট্টাচার্যের 'হাওড়া জেলার ইতিহাস' বইখানি পড়তে পড়তে মনে হল টাইম মেশিনে করে চলে যাচ্ছি কবেকার অষ্টম শতাব্দীর বাঙ্গালায়। পাল বা কোন সামন্ত রাজাদের আমলে। অতীতের ভূরিশ্রেষ্ঠী গ্রামে। সেই গ্রামের পাশ দিয়ে তরতর করে বয়ে চলেছে দামোদর। বহু বার গতিপথ পরিবর্তন করে আজ সে ক্লান্ত। তবু কি গভীর সেই অতীতের দামোদর, কি প্রবল তার জলস্রোত। সেই নদীর বুকে বড় বড় জাহাজের সমাবেশ। রেশমি কাপড়, শস্য, আরও কত কি বোঝাই সেই জাহাজ চলেছে তাম্রলিপ্ত বন্দর। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলি সন্ধ্যার পর একে একে যেন জেগে উঠছে। চারদিকে শঙ্খধ্বনি। আলো। গ্রামে ভূরি ভূরি শ্রেষ্ঠী বা বণিকদের বসবাস। তাই বোধ হয় গ্রামের নাম ভূরিশ্রেষ্ঠ। বিশাল বিশাল অট্টালিকা শ্রেষ্ঠীদের বিপুল ঐশ্বর্যের প্রমাণ দিচ্ছে। গ্রামে যেমন লক্ষ্মীর বসতি। তেমনই সরস্বতীর। দক্ষিনী রাঢ় ব্রাহ্মণদের বড় প্রতিপত্তি। ন্যায়, দর্শন, গণিতশাস্ত্রে তারা সুপণ্ডিত। এরকমই এক সন্ধ্যায় আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে শ্রীধর আচার্য তার বাগান বাড়ির প্রদীপের আলোয় পুঁথি নিয়ে বসেছেন। লিখছেন তার 'ত্রিশতিকা' গ্রন্থের প্রথম শ্লোকটি।
ডিহিভূরশুট যেতে আমার বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু রাস্তার যা অবস্থা। গর্তে গর্তে পথের শ্রী বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। তাতে চোখের চশমা ভিজে যায়। দৃষ্টি বেশি চলে না। আমি সেই গর্ত এড়িয়ে, বৃষ্টি মাথায় করে সাবধানে বাইক চালিয়ে অগ্রসর হতে থাকলাম। চারিদিকে চেয়ে দেখি অতীতের ভূরিশ্রেষ্ঠীর আজ চিহ্নমাত্র নাই। রাস্তার পাশের জেলে-দুলেদের বসতিগুলোতে দারিদ্র্যের ছাপ সুস্পষ্ট। ত্রিপলে ঘেরা তাদের কষ্টের জীবন দেখা যায় না। এই সময় এলাকায় শুঁকটি মাছ খাওয়ার চল রয়েছে। মাঝে মাঝেই সেই গন্ধ নাকে আসতে লাগল। আর্দ্র আবহাওয়ায় সেই গন্ধ অনেকদূর ছড়িয়ে পড়েছে। আমি গন্ধ উপেক্ষা করে এগিয়ে চললাম আমার গন্তব্যস্থানে।
ডিহিভূরসুট বাসস্ট্যান্ডে এসে যথারীতি গুলিয়ে ফেললাম কোন দিকে যেতে হবে। কৃষ্ণ নামে এক জুনিয়র বন্ধু আমায় রাস্তাটা বলে দিয়েছিল। ভুলে যাব বলে একটা চিরকুটে লিখেও রেখেছিলাম। কিন্তু সময়কালে সেই কাগজটা নিতে ভুলে গেছি। যতদূর মনে হল এখান থেকে আমায় সোরপুর মাঠ যেতে হবে। মিষ্টির দোকানে একটা লোক বসে পরম সুখে পান চিবচ্ছিল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম রাস্তাটা। সে শুনল - সোদপুর। পানের বোঁটায় একটু চুন লাগিয়ে জিভে দিল। তারপর বলল - 'সোদপুর অনেকদূর রাস্তা। আপনি উলটোদিকে এসেছেন'। আরেকজন বলল - 'সৌরভপুর বলে এখানে কিছু নেই। রহিমপুর ওইদিকে।' বলে একটা পিচরাস্তা দেখিয়ে দিল। এদিকে কৃষ্ণকেও ফোনে পাচ্ছি না। ভারি সমস্যা। কিছুদূর ভুল পথে যাওয়ার পর কৃষ্ণ আমায় ফোন করল। সঠিক পথে নিয়ে এল। ভাবলাম - বাহ! কৃষ্ণ যখন সারথি তখন অর্জুনের আর ভয় কি। ঠিক পৌঁছে যাব!
কৃষ্ণ তার বাইকটা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল আমায় নিতে। বলল - 'ওটা সুরপুর মাঠ ছিল। সোরপুর নয়।' আমার ভুল বুঝতে পারলাম। কৃষ্ণ কোলকাতায় কম্পিউটারের একটা কাজ করে। ফিজিক্স নিয়ে পড়েছে। বলল - 'আমি আমার বন্ধুদের বলি, জানিস শ্রীধর আচার্যের বাড়ি আমার এখানে। কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। হেসে উড়িয়ে দেয়। তাই আর কাউকে বলি না। তুমি যদি শ্রীধর নিয়ে বইটা লেখ, তাহলে তাদের দেখাব। তখন হয়ত তারা বিশ্বাস করবে।' আমি বললাম - 'দেখা যাক, কতদূর তথ্য পাই।' কৃষ্ণ বলল - চিন্তা কোর না। কিছু তো পাবেই। এখানে একটা গ্রামীণ পাঠাগার রয়েছে। ডিহিভূরসুট শান্তিনীড় পাঠাগার। সেখানেও কিছু তথ্য পেতে পার।' সে আমায় তার বাড়িতে একটু মিষ্টি জল খাওয়ার অনুরোধ করল। আমি বাইকটা কৃষ্ণের বাড়িতে রাখলাম। চারটে নলেন গুড়ের রসগোল্লা সহযোগে জলপান করে আচার্যের ভিটে দেখতে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম।
কৃষ্ণ যে জায়গাটা আচার্যের ভিটে বলে চিহ্নিত করল, সেটা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম!
ভিটেটা খুব বেশি জায়গা জুড়ে আজ আর নেই। মেরে কেটে কয়েক শতক হবে। যেটুকু আছে সেখানে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে। প্রকৃতির আপন খেয়ালে। বনতুলসী, কচু, আরও কয়েকটা বড় বড় কলা গাছের ঝাড় সাড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বনলতায় ভিড় করে আছে চারিদিক। না জানি কোন সুদূর অতীতের সাক্ষী বহন করে চলেছে। কলা গাছে কয়েকটা মোচাও ফলেছে দেখলাম। এদিকে কেউ আর আসে না। দিনের বেলায় সাপ খোপ আর পোকামাকড়ের ভয়। রাত্রে ভূতের। অথবা নেহাত শেয়ালের। কৃষ্ণ বলেছিল, এই ভিটেতে নাকি একটা দেওয়াল ছিল। আজ আর সেই দেওয়ালেরও চিহ্ন নেই। সময়ের অবক্ষয়ে কবে মিশে গেছে মাটিতে। ভিটের দুই প্রান্তে দুটি বড় বড় পুকুর। পুকুর গুলোরও সংস্কার নেই। পানা এবং বুনো ঝোপঝাড়ে ভর্তি। ভিটের সামনে কতকগুলো জমিতে আলু বসানো হয়েছে। গ্রামের লোক নাকি আস্তে আস্তে জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে। ভাবলাম কয়েকবছর পর এই জঙ্গলাকীর্ণ ভিটেখানিও হয়ত জমি হয়ে যাবে। আচার্যের শেষ সম্বলটুকু গ্রাস করে নেব আমরা। আমাদের সভ্যতা! তার আগে একবার জায়গাটা খুঁড়ে দেখলে হয় না! যদি কিছু পাওয়া যায়!
ভিটের পাশেই একটা পাকা বাড়ি। সেই বাড়ি এক মাস্টার মশাই-এর। সোমনাথ মুখার্জির। সোমনাথ বাবু এককালে শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কোন পরিচয় ছিল না সোমনাথ বাবুর। কিন্তু ওনার নাম শুনেছিলাম। কৃষ্ণ বলল - 'একবার সোমনাথ বাবুর সাথে দেখা করা যাক। এখানকার মানুষ। হয়ত কিছু তথ্য মিললেও মিলতে পারে।' আমি একমত হলাম। কিন্তু ওনার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলাম, বাড়িতে তালা ঝুলছে। পাশেই একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। তিনি জানালেন যে সোমনাথ বাবু কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্গালোর গিয়েছেন। বাড়িতে নেই।
ওই ভদ্রলোকের বয়স বোধ হয় সত্তর পেরিয়েছে। কিন্তু শরীরে বেশ চাকচিক্য রয়েছে। কথাবার্তাতেও একটা মার্জিত ভাব। আমরা ওই ভদ্রলোককেই শ্রীধর আচার্যের কথাটা পাড়লাম। ভদ্রলোক বললেন - 'হ্যাঁ, ওই জঙ্গলটা এককালে আচাজ্জিদের বাড়ি ছিল। আমরাও ছোটবেলায় শুনেছি। তখন একটা দেওয়ালও ছিল। এখন গাঁয়ের লোকে বলে ওখানে নাকি ভূতেদের বসবাস।' আমি বললাম - 'আচাজ্জিদের বংশধরদের কোন খোঁজ পাওয়া যেতে পারে?' ভদ্রলোক বললেন - 'তা তো বলতে পারব না। তারা অনেকদিন এখান থেকে উঠে গেছেন। এখন কোলকাতায় থাকেন।' বলে গামছায় মুখ মুছতে লাগলেন। আমি একটু মুষড়ে পড়লাম। এখন বিপুল কোলকাতা মহানগরীতে শ্রীধর আচার্যের বংশধরদের কিভাবে খুঁজি? কৃষ্ণ জানাল ওই ভদ্রলোক এককালে গ্রামের প্রধান ছিলেন। বেশ প্রাচীন লোক। কিন্তু এই প্রবীণের থেকেও বেশি কিছু জানতে পারলাম না। তবে মোটকথা যেটা পরিষ্কার হল এখানে কোন এক আচার্য থাকতেন। তবে সেই আচার্য শ্রীধর আচার্য কিনা সেটা খুঁজে বার করতে হবে!
ভাবলাম আমরা দেড় হাজার বছরের পুরনো এক মানুষের খোঁজ করছি। বেগ তো পেতে হবেই। ইংরেজ তখনও এ দেশে আসেনি। মুলসিম আক্রমণ তখনও বাংলায় হয়নি। ইতিহাস বলে - প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজা ছিলেন শশাঙ্কদেব। গৌড়রাজ শশাঙ্কের সহিত যুদ্ধ হয় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার। যুদ্ধে শশাঙ্কের পরাজয় হলে প্রায় একশ বছর ধরে বাংলায় চলে চরম অরাজকতা। বৈদেশিক আক্রমণ। যাকে বলে 'মাৎস্যন্যায়'। সেই অরজাকতা থেকে মুক্তি পেতে গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে রাজা হিসাবে নির্বাচন করা হয়। এভাবেই বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠা। তারও পরে শূরবংশের রাজারা নাকি অতীতের এই ভূরসুট গ্রামে রাজত্ব করতেন। শোনা যায় পান্ডুদাস নামে এক কায়স্থ রাজা পৃষ্ঠপোষকতা করেন শ্রীধর আচার্যের। সে আজ কবেকার কথা। সেই প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে তথ্য খুঁজে বার করতে আমাদের চাই ধৈর্য। গবেষণার সুবাদে এই ধৈর্যের ব্যাপারটা বেশ রপ্ত করেছি। আজ একটা ডেটা নিলে বছর তিনেক পর সেটা পাবলিশ হয়। তাই আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
আমাদের পরের গন্তব্যস্থল ছিল পাঠাগারটি। দেখি যদি এই এলাকার ইতিহাস নিয়ে বই পত্তর কিছু খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণ জানাল পাঠাগার এগারোটার সময় খোলে। এখন বাজে প্রায় সাড়ে এগারোটা। সুতরাং আমরা পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম লাইব্রেরির দিকে। ডিহিভুরশুট শান্তনীড় পাঠাগার। কিন্তু লাইব্রেরীর সামনে এসে যা দেখলাম তা বলার কথা নয়। লাইব্রেরী বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। লতাপাতা সেই বন্ধ লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে প্রবেশ করেছে। যদি বই পত্তর কিছু থেকে থাকে তবে উইপোকায় আস্ত রাখবে না। পাঠাগারের সামনেই একটা বারান্দা। বারান্দায় বসে কটা লোক মুড়ি খাচ্ছিল। চাষিবাসী মানুষ। ওদের ঘাঁটালাম না। বৃষ্টি একটু থেমেছিল। এক দম্পতি ছিপ নিয়ে পুকুরে মাছ ধরছিল। পুকুরে সাদা হাঁসের দল খেলা করছে। কয়েকটা পায়রা ব্যস্ত হয়ে রাস্তায় ধান খুঁটে খাচ্ছে।
আমি আর কৃষ্ণ সেই বন্ধ লাইব্রেরীর দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলাম। শ্রীধর আচার্যের খোঁজে এখন কোথায় যাব?
আচার্যের খোঁজে বেরিয়ে এই বন্ধ পাঠাগারের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম বাঙ্গালী পড়াশোনার উপর আস্থা হারিয়েছে। পড়াশোনা করে আর কি হবে! কোথাও চাকরি নেই যে। এভাবেই আমরা হারিয়ে ফেলছি কতকিছু। হারিয়ে ফেলছি আমাদের ভবিষ্যৎ। আমার পাশের গ্রামেই ছিল শ্রীরামপুর গ্রামীণ পাঠাগার। ছোটবেলায় কত বই নিয়ে পড়েছি সেখান থেকে। সত্যজিৎ, বঙ্কিমচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র। একবার মনে আছে বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা' বইটা লাইব্রেরীতে বসেই পড়া শেষ করে আবার একটা নতুন বই বাড়ি নিয়ে আসি। কয়েকবছর আগে সেই লাইব্রেরীও বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সেই সব বই কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। সেখানের লাইব্রেরিয়ান টুটুলদার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। চা খাই। এটা সেটা গল্প করি। দামোদরের তীরে বসে অতীতের ঝরে যাওয়া দিনগুলির কথা বলি।
পাশের চিলাডাঙ্গি গ্রামেও একটা লাইব্রেরী কয়েক বৎসর আগে ধুমধাম করে শুরু হয়েছিল। আমি কয়েকটা বই দানও করি লাইব্রেরীতে। সেই পাঠাগারও আজ বন্ধ। কে পড়বে বই? শুধু আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে অনেক ক্লাব। টাইগার, ডাইনোসর, আমরা কজন, তোমরা দুজন, ইত্যাদি সব ক্লাবের নাম। সেখানে পুজো হয় বারো মাস। কালীপূজো। ভীমপুজো। দুর্গাপূজা। সূর্যপুজো। আরও কতকি। আর পুজো মানেই ডি জে র গান। গান কম। শব্দদূষণ বেশি। 'কুব কুব' 'ঢুব ঢুব' শব্দে কানের দফারফা। মাথা ঝিম ঝিম।
কৃষ্ণই প্রস্তাবটা দিল। লাইব্রেরী যখন বন্ধ। তখন লাইব্রেরিয়ানের খোঁজ করে দেখা যাক। এই বন্ধ পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান প্রশান্ত ভারতী নামক এক ভদ্রলোক। প্রশান্তবাবু নাকি খুব 'জেনুইন' লোক। চাঁছাছোলা ভাষায় কথা বলেন। স্পষ্টবাদী। এককালে নকশাল করতেন। চারু মজুমদার, ইত্যাদি নকশাল নেতাদের অনুগামী ছিলেন। পড়াশোনায় ভীষণ ভালো ছিলেন। আদর্শবাদী। নিজের স্ত্রী পুত্রকেও নাকি কাজের বেতন দেন!
পাঠাগার পেরিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে কচিকাঁচারা খেলাধুলায় ব্যস্ত। আরও কিছদুরে, অলিগলি, ধুঁকতে থাকা কুকুর, গৃহস্থের চালে ঝুলন্ত লাউশাক, গোরুর গোয়াল ঘর, ছোটো আল পেরিয়ে লাইব্রেরিয়ানের বাড়ি। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হল। লাইব্রেরিয়ান বাড়িতে নেই। ওনার স্ত্রী জানালেন প্রশান্তবাবুর কদিন ধরেই জ্বর। জ্বরের বড়ি আনতে বাজারে গিয়েছেন। কখন আসবেন তার কোন ঠিক নেই। তাঁর স্ত্রী কৌতূহলবশত আমাদের আগমন উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করলেন। জানালাম- 'আমি শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটা বই লিখছি। আচার্য সম্পর্কে যদি কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারি, তাই আমার এখানে আসা।' গ্রন্থগারিক-পত্নী জানালেন - 'সেসব তো আমি কিছু জানি না বাবা। তবে উনি জানবেন। দুবছর আগে কেউ একজন এসে ওই জায়গাটা থেকে মাটি খুঁড়ে নিয়ে গেছে। দুদিন ছিল। আমাদের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করেছিল। তবে তার বেশি আমি জানি না। পরে কখনো এসো। ওনার সাথে দেখা হলে জানতে পারবে। 'তুমি' করেই বলছি। তুমি আমার ছেলের বয়সী। তার থেকেও ছোট হবে। তোমাকে দেখেই মনে হয় তুমি পড়াশোনায় খুব ভালো।' নিজের প্রশংসা শুনতে একদম ভালো লাগে না। তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম - 'আচ্ছা মাসিমা। পরে আসব। এখন উঠি।'
মনে মনে ভাবলাম - বা! রহস্য বেশ ঘনিয়ে উঠেছে। এখানে কি আরকিওলজি বিভাগ থেকে আগে কেউ এসেছিল? নাকি আমার মতও কেউ পাগল আছে? শুধু সেই পাগল শ্রীধর আচার্যের খোঁজই করেনি আবার মাটি খুঁড়ে নিয়ে গেছে। সে কি কিছু জানতে পেরেছে? নাকি এটা একটা ডেড এন্ড! খুব জানতে ইচ্ছা করছে। লাইব্রেরিয়ানের আর জ্বর হওয়ার সময় পেল না! যাইহোক, কৃষ্ণ জানাল লাইব্রেরিয়ানের থেকে কোন লিড পেলে আমায় জানাবে।
শীতের বেলা খুব ছোট। রোদ পড়ে আসছে। তাই আমি আর দাঁড়ালাম না। বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। গোয়ালারা বড় বড় দুধের হাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছে। চাষিরা অনেক আগেই ঘরমুখো হয়েছে। দিনের বেলাতেই দুই চারটে শেয়াল জমিতে দেওয়া ধানের গাদায় ঘোরা ফেরা করছে। বোধ হয় ইঁদুর ধরছে। অথবা গৃহস্থের ছাগল-মুরগী ধরার তালে আছে। হঠাৎ মনে পড়ল বাড়িতে আজ দেশী মুরগী রান্না হয়েছে। পেটের মধ্যে খিদেটা চোঁ চোঁ করে বেড়ে উঠল।
যেকোন ধরনের গবেষণায় ফিল্ড বা বেঞ্চ ওয়ার্কের সাথে ডেস্ক ওয়ার্ক সমান ভাবে জরুরী। আমাদের কেমিস্ট্রির লাইনে বলা হয় কোন রিয়াকশন হুটহাট চাপিয়ে দিতে নেই। আগে সেই নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করা দরকার। আগে কি কি বিক্রিয়া লোকে করেছে সেসব তলব করা প্রয়োজন। তাদের কোথায় খামতি ছিল সেটা দেখা। তারপর এগিয়ে যাওয়া। এক সপ্তাহের পড়াশোনা নাকি এক মাস ল্যাবটরিতে কাজ কমিয়ে দিতে পারে। তাই ভাবলাম শ্রীধর আচার্য নিয়ে যেরূপ মাঠে ঘাটে খোঁজাখুঁজি চলছে চলুক, তার সাথে এই নিয়ে পড়াশোনারও কিঞ্চিৎ প্রয়োজন।
স্কুলের অজিতবাবুর সুপারি চিবানো মুখশ্রী থেকে ‘মাইনাস বি, প্লাস মাইনাস রুট ওভার’ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং কয়েকটি বীজগণিতের অঙ্ক ছাড়া আচার্যের গণিত সম্পর্কে কিছুই জানি না। একটু খোঁজাখুঁজি করে জানলাম শ্রীধর আচার্য যে বইগুলি লিখেছেন তার মধ্যে ‘পাটিগণিত’ বইটিতে নয়শো সূত্র শ্লোক আকারে রয়েছে। কিন্তু এই বইয়ের মূল কপিটি হারিয়ে গেছে বা অসম্পূর্ন। তাঁর লেখা ‘বীজগণিত’ বইটিরও চিহ্ন নেই। যেটা আছে সেটা ‘পাটিগণিত’ বইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত ভার্সান। যেটাকে বলে ‘পাটিগণিতসার’। এই বইটির কিছু কপি এখনো আছে। এখানে নাকি তিনশোটি শ্লোক রয়েছে। তাই বইটি ‘ত্রিশতিকা’ নামেও পরিচিত। গোয়েন্দাদেবী সদয় হয়েছেন দেখলাম। আমাজনে এই বইটি পাওয়া যাচ্ছে। তাই তড়িঘড়ি করে বইটির অর্ডার করে দিলাম।
শ্রীধর আচার্য যেই সময়ে বিরাজ করতেন সেই সময়কার বাংলার পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভের জন্য নীহাররঞ্জন রায়ের “বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)”, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বাঙ্গালার ইতিহাস” এবং নিতীশ সেনগুপ্তর “Land of two Rivers: History of Bengal from the Mahabharata to Mujib” বইগুলিও অর্ডার করলাম। অচল ভট্টাচার্যের “হাওড়া জেলার ইতিহাস” বইখানি আগেই সংগ্রহ করেছিলাম। অর্ডার তো করলাম। কিন্ত মাঝখান থেকে কয়েক হাজার টাকা পকেট থেকে খসল। তাই মনটা খারাপ হয়ে গেল। এটাকে একটা ‘ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট’ বলে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। তাছাড়া ভাবলাম একটা মহৎ কাজ করছি, এর মধ্যে টাকা পয়সা আসে কোথা থেকে?
যাইহোক, কৃষ্ণ সেদিন ফোন করল। বলল আমাদের সেই লাইব্রেরিয়ান প্রশান্তবাবুর খোঁজ মিলেছে। সে তার সাথে শ্রীধর আচার্য নিয়ে কিছু কথাও বলে এসেছে। তাদের কথোপকথনটি ছিল মোটামুটি এইরূপ।
কৃষ্ণ প্রশান্তবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, আপনি শ্রীধর আচার্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?” প্রশান্তবাবুর প্রশ্নটা বোধ হয় বেশ পছন্দ হয়েছিল। এরকম প্রশ্ন তো সচারচর তাঁকে কেউ করেন না! তাঁর পছন্দের একটা টপিক পেয়েছেন। নিজের গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর শুরু করলেন, “শ্রীধর আচার্য। হ্যাঁ, শ্রীধর আচার্য একজন ভারত বিখ্যাত লোক ছিলেন। গণিতবিদ । ওই বীজগণিতের কিছু সূত্র দিয়েছিলেন। কতকগুলো জ্যামিতির সূত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। এ সম্পর্কে জানতে উনিশ শো সাতানব্বই সালে দিল্লি থেকে একটা ছেলে আমার কাছে এসেছিল। তার বাড়ি হচ্ছে তারকেশ্বর। রজত চক্রবর্তী। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরকিওলজি বিভাগের প্রোফেসর। তার কাছে কিছু জানতে পারিস। খোঁজ করে। নামটা নোট করে নে। রজত চক্রবর্তী। বাড়ি তারকেশ্বর। আর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে কিছু বইপত্র পাবি। এশিয়াটিক সোসাইটি। বুঝতে পেরেছিস?” কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করল – “এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে কি বই? বইগুলোর নাম কিছু জানেন?” প্রশান্ত বাবু বললেন – “বইগুলোর নাম তো আমি এখন আর জানি না। তবে একটা বইয়ের নাম ‘ন্যায়কুণ্ডলী’। ‘হাওড়া জেলার ইতিহাসে’ও এই বইটার নাম পাবি। হাওড়া জেলার ইতিহাসের উপর দুটো বই লেখা হয়েছে। একটা হল অধ্যাপক অচল ভট্টাচার্যের। প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ড। আরেকটা হচ্ছে হেমেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওটা আরও অথেনটিক। মোটা বই। আর আলিপুর ন্যাশনাল লাইব্রেরী থেকে কিছু বই পত্র পেতে পারিস। কিছুই নয়। ওখানে যেতে হবে। আর মেম্বারশিপটা নিতে হবে।“
এই কারণেই লাইব্রেরিয়ানদের আমার এত ভালো লাগে। ফটাফট যত বইয়ের নাম বলে দিতে পারেন ওরা। স্যালুট! যাক অনেকগুলো লিড পাওয়া গেছে আজ - যাদবপুর। রজত চক্রবর্তী। আরকিওলজি বিভাগ। ন্যায়কুন্ডলী। এশিয়াটিক সোসাইটি।
তবে কি আমার পরের গন্তব্যস্থল কোলকাতা?
কৃষ্ণ প্রশান্তবাবুকে জিজ্ঞাসা করল – ‘আচ্ছা। আপনি আচার্যের বংশধরদের কথা কিছু বলতে পারবেন?’
প্রশান্তবাবু মাথা চুলকালেন। তারপর বললেন – ‘হুম। ওদের বংশধরদের কিছুই তেমন খোঁজ কিছু পাই নি, বুঝলে! লাস্ট বংশধর যারা ছিল…’ বলে থামলেন। তারপর শুরু করলেন - ‘আমরা তখন ছোট। এই পাল পুকুরে চান করতে যেতুম। ওদের একজন বংশধর ছিল – ওরা তিন ভাই ছিল। এই এই খানে বাড়ি ছিল।‘ এই বলে তিনি সামনের বাঁশঝাড়ের দিকে হাত দেখালেন। ‘একজনের নাম ছিল পুলিন আচার্য। তাঁর মেয়ের নাম ছিল...” অনেকক্ষণ মনে করতে পারলেন না। সময় নিলেন। তারপর বললেন –“মেয়ের নাম ছিল পদ্মাবতী আচার্য। ওদের বাড়িটা ... মঞ্জুরি পাল কিছুটা বলতে পারবে। মঞ্জুরি পালকে চিনিস তো? কৌশিক পালের বাবা।‘
কৃষ্ণ বলল – “দেখিনি কোনদিন। তবে নাম শুনেছি।“
প্রশান্তবাবু বললেন – “কৌশিক হচ্ছে ম্যাথামেটিক্স অনার্সের টিচার। হরিণখোলা ইস্কুলের। আগে ছিল বেলঘরিয়া ইস্কুলে। আমি ওকে যখন বলি এই শ্রীধর আচার্য সম্পর্কে তখন ওর খুব আগ্রহ জন্মায়। আগ্রহ জন্মাতে ... ও তখন বেলঘরিয়া ইস্কুলের শিক্ষক। তারপর কিছুদিন পর বলল – ‘হ্যাঁ কাকা তুমি ঠিকই বলেছ গো! আমি কিছু ইংরাজি বইয়ে তথ্যগুলো পেয়েছি। ইংরেজি বই। বুঝলি?”
কৃষ্ণ বলল – “হ্যাঁ, ইউনাইটেড কিংডমের একজন ওনাকে নিয়ে লিখেছেন।“
প্রশান্ত বাবু বললেন – “ও আচ্ছা। কিন্তু দিল্লি থেকে যে এসেছিল। আমারই খোঁজ করে করে এসেছিল। কারণ আমাদেরই বাড়ির পরিচিত ছেলে। তিনদিন এসেছিল। আমি ওকে থাকতে দিয়েছিলুম। আমাদের বাড়িতে খেত। আমি ওকে গর্ত খোঁড়ার জন্য সাহায্য করতুম। কিন্তু ও বেশি খুঁড়তে পারেনি তো! কিন্তু তাতেই যা খুঁড়েছিল তা দেখে বলল – খুব সম্ভব এই জিনিসগুলো পাঁচ ছয় শো বছরের পুরনো।“
প্রশান্তবাবু এখন রজত চক্রবর্তির কথা বললেন। যিনি এখন নাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই অধ্যাপকের কথা যতই শুনছি বেশ আশ্চর্য লাগছে আমার। একটা জিনিস দেখে কত সালের বলে দেওয়া যায় কিনা জানি না। কিন্তু অধ্যাপকের বেশ মনের জোর আছে দেখছি। এখানে এসে মাটি খুঁড়ে জিনিস বার করে নিয়ে গেছে। কিন্তু কি পেয়েছিলেন রজত?
প্রশান্তবাবু আবার বলা শুরু করলেন – “তো আমি রজতকে বললাম তুমি গবেষণার জন্য এসেছ। ভাল কথা। কিছু পেলে একটা গবেষণাপত্রের কপি আমায় দিও। একটা আমার কাছে রাখব। আর একটা ডিহিভূরশুট শান্তনীড় পাঠাগারে রাখব।“
পাঠাগারের কথা উঠতে কৃষ্ণ প্রশ্ন করল – “আচ্ছা পাঠাগারটা বন্ধ হয়ে গেল কেন?”
প্রশান্তবাবু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন – “এখন পশ্চিমবঙ্গে কোন সরকার? দু হাজার চারশ আশিটা গ্রন্থাগারের মধ্যে এক হাজার পাঁচশর মত গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গেছে। কোন রিক্রুটমেন্ট নেই। বইগুলো সব উই এ খাচ্ছে। কোন এমপ্লয়ী নেই। টাকা কোথা থেকে পাবে সরকার? এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, হ্যাকো, ঢ্যাকো হচ্ছে। লাইব্রেরীগুলোর কোন রিক্রুট নেই। পনেরশোর উপর গ্রন্থাগার বন্ধ। হাওড়া জেলার একশ পঁইত্রিশটি গ্রন্থাগার। তেতাল্লিশ না পয়তেল্লাশিটা গ্রন্থাগার পুরো বন্ধ। এই শান্তনীড় গ্রন্থাগারের শুধু জায়গাটা রয়েছে। বিল্ডিংটা রয়েছে। লাইব্রেরীর একটা আলমারির বই পুরো উইয়ে খেয়ে নিয়েছে।”
যদিও প্রশান্তবাবুর এই পরিসংখ্যান ঠিক কিনা তা যাচাই করে দেখিনি, তবু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও প্রশান্তবাবুর কথাকে সমর্থন করে। অনেক গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গেছে। এর জন্য শুধুই কি সরকার দায়ী, না আমরাও কিছুটা দায়ী? আমরা কি বই পড়তে ভুলে যাচ্ছি না?
কৃষ্ণ লাইব্রেরী থেকে আবার শ্রীধর আচার্যের প্রসঙ্গে ফিরে গেল। বলল – “কিছুদিন আগে নাকি আপনার বাড়ি কেউ এসেছিল খেয়ে গেছে। এই ধরুন দু হাজার উনিশ সালে?
প্রশান্তবাবু বললেন – “আমাদের বাড়ি সাতানব্বই সালে এসেছিল। রজত চক্রবর্তী। তিনদিন ছিল। তারপরে কেউ আসেনি।”
পরের সপ্তাহেই ‘কালটিভেশন অব সায়েন্সে’ আমার একটা বিজ্ঞান লেকচার আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। ভাবলাম যাচ্ছি যখন একবার রজত চক্রবর্তির খোঁজ নিয়ে দেখব। সম্ভব হলে কথা বলব। শ্রীধর আচার্যের অন্বেষণে রজতবাবু একটা গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন। যাদবপুরের আমার কিছু বন্ধুবান্ধবও আছে। দেখি তাদের থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায় কিনা। আর কৃষ্ণকে বললাম মঞ্জুরি পালের সাথে কথা বলতে। আচার্যের বংশধরদের কিছু সুলুক সন্ধান পাওয়ার জন্য।
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। শীতের শুরুতেই এই সময়টাতে বৃষ্টি একেবারেই অনঅভিপ্রেত। আলুচাষের উপযোগী নয়। জানালা দিয়ে দেখলাম কলাগাছের পাতাগুলো ঘনঘন বাতাসে দুলছে। ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে একটা ঝিঙেগাছ বেড়ে উঠেছে। তাতে কটা ফুল। ঝিঙেফুল। দূরে দুটো সাদা বক ত্রস্ত হয়ে জমিতে পোকা মাকড় ধরার জন্য ঘুরে চলেছে। এই বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় রাস্তায় এক পথিক হেঁটে চলেছে। দিন কতক আগেই শ্রীধর আচার্যের লেখা 'ত্রিশতিকা' বইটি বাড়িতে ডেলিভারি দিয়েছিল। আজ কাজের চাপ সেইরকম নেই। তাই বইটা পড়ার একটু অবকাশ পেলাম।
বইটি হাতে নিতেই খোঁজ করলাম স্কুল জীবনের বিখ্যাত সেই দ্বিঘাত সমীকরণের সূত্রটি এখানে রয়েছে কিনা। এই নিয়ে স্নেহাশিস দাও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। স্নেহাশিসদার সাথে আমার পরিচয় কলোরাডোতে। আমি তখন ওখানে গবেষণা করতাম। স্নেহাশিসদা শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা আমায় বলেছিল। ওর একটা ল্যাবমেট ছিল। নাম ফিলিপ। বেশ লম্বা চওড়া মিতভাষী ফরাসী ছেলেটি। আমিও দেখছি কয়েকবার ফিলিপকে। একদিন ফিলিপ একটি দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধান করতে শ্রীধরের সূত্রটি ব্যবহার করেছিল। স্নেহাশিসদা বলল - 'ফিলিপ, তুমি জানো এই সূত্রটি কার?' ফিলিপ বলেছিল - 'নামটা জানি না। তবে এটা কোন ভারতীয় ঋষির দেওয়া সূত্র হবে।’ স্নেহাশিসদা বলল - "হ্যাঁ, সেই ভারতীয় ছিলেন শ্রীধর আচার্য"। পরে স্নেহাশিস দা আমায় বলেছিল - 'ইস। যদি জানতাম শ্রীধর আচার্য বাংলার লোক ছিলেন, তাহলে আরও ফলাও করে বলতাম ফিলিপকে।'
'ত্রিশতিকা' বইটার ভূমিকাটা পড়ে একটু হতাশই হলাম। না, এই বইটিতে দ্বিঘাত সমীকরণের সেই সূত্রটি নেই। যে বইয়ে রয়েছে সেটির নাম 'বীজগনিত'। সেটাই হওয়া স্বাভাবিক। এই সমীকরণ আমরা ছেলেবেলায় বীজগণিত বইয়েই পেয়েছি। পাটিগণিতে নয়। যাই হোক, যতদূর জানতে পেরেছি শ্রীধরের লেখা 'বীজগণিত' বইটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। হয়ত বা লুকিয়ে আছে কোন এক অজ্ঞাত গ্রন্থাগারে! যেখানে তালা ঝুলছে। তার জানালা বেয়ে উঠে গেছে লতাপাতা। জঙ্গল। আর সেইসব প্রাচীন অমূল্য পুঁথি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে উইপোকারা।
'বীজগণিত' বইটির অস্তিত্ব না থাকলেও আচার্যের লেখা সেই বইয়ের এবং সূত্রগুলির উল্লেখ করে গেছেন অনেক গণিতবিদরাই। মহাসিদ্ধান্তের রচয়িতা দ্বিতীয় আর্যভট্ট (৯৫০ খ্রী) থেকে 'গণিত তীলকা'র রচয়িতা শ্রীপতি মিশ্র, 'গণিত কৌমুদী'র লেখক নারায়ণ (১৩৩৬ খ্রী), ভাস্করাচার্য-২ (১১৫০ খ্রী), মাক্কি ভট্ট (১৩৭৭ খ্রী), রাঘব ভট্ট (১৪৯৩ খ্রী) প্রভৃতি গণিতবিদরা শ্রীধর আচার্যের কাজের বিবরণ দিয়েছেন। ব্যবহার করেছেন তাঁদের নিজেদের কাজেও। এই সব উল্লেখ থেকে বুঝতে পারা যায় তাঁর কাজ কত জনপ্রিয় ছিল সেই প্রাচীন কাল থেকেই।
শ্রীধরের সমীকরণের প্রথম উল্লেখ যে বইয়ে পাওয়া গিয়েছিল সেই বইটি ছিল দ্বিতীয় ভাস্করাচার্যের লেখা বই 'বীজগণিত'। হ্যাঁ, এই বইয়ের নামও 'বীজগণিত'। ভাস্করাচার্য যে বইগুলি লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন তার মধ্যে 'লীলাবতী' এবং ‘বীজগনিত’ ছিল অন্যতম। জানা যায় লীলাবতী ছিলেন ভাস্করাচার্যের কন্যা। কন্যার নামে এই বইটি আসলে পাটিগনিতের। এখানে ২৭৭ টি শ্লোক ছিল। আর ‘বীজগনিত’ বইটিতে ছিল ২১৩ টি শ্লোক। এই বইটিতে তিনি শূন্য, অসীম, ধনাত্মক, ঋণাত্মক সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর এখানে ছিল বিখ্যাত Pell’s equation এর সমাধানও। এই নিয়ে পরে কখন আলোচনা করব। ভাস্করের লেখা ‘লীলাবতী’ এবং ‘বীজগনিত’ বইগুলি নিয়ে একটা ঘটনার কথা পড়লাম। যেটা না বললেই নয়।
এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স সাহেব কালিদাসের লেখা 'শকুন্তলা' পড়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সংস্কৃত শিক্ষক রামলোচনের সঙ্গে এই নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনাও করেছেন। কালিদাসকে 'Indian Shakespeare' বলে প্রশংসা করে ইংল্যান্ডে চিঠি লিখতেন। প্রাচীন ভারত যে সাহিত্যে কত উন্নতি করেছিল তাঁর প্রমাণ দিতেন। আবার বেদ, বেদান্ত, গীতার পাঠ করার পর তাঁর মনে হয়েছিল ভারতবাসীদের থেকে আমরা দর্শনশাস্ত্র বিষয়েও অনেক জ্ঞানলাভ করতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞানের কথা উঠলেই তিনি হয়ে যেতেন অন্যরকম। ইউরোপীয়দের একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা উচ্চকণ্ঠে বলতেন। 'Sciences…it must be admitted that the Asiaticks, if compared with our Western notions, are mere children’. কোথায় ভারতের গ্যালিলিও, নিউটন আর কোপারনিকাস? স্যার জোন্সের এই ধারনা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করেন এশিয়াটিক সোসাইটির আরেক সদস্য হেনরি কোলব্রুক। কোলব্রুক খুঁজে পেয়েছিলেন ভাস্করাচার্যের লেখা 'বীজগণিত' এবং 'লীলাবতী' বইগুলি। সেখানে খুব সুন্দর এবং সহজ সমাধান ছিল কঠিন কঠিন সমীকরনের। পেয়েছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত এবং আর্যভট্টের সন্ধানও। এইসব প্রাচীন বিখ্যাত গণিতবিদদের লেখা তিনি তুলেন ধরেন পশ্চিমের দেশের মানুষজনদের কাছে। বুঝিয়ে দেন গণিত, জ্যোতির্বিদ্যাতেও প্রাচীন ভারত যথেষ্ট উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
ভাস্করাচার্য তাঁর 'লীলাবতী' বইটিতে শ্রীধরের সূত্রটি এইভাবে বর্ননা করেছেন -
चतूराहतवगसमै रूपैः पक्षदवयं गुणयेत् ।
अव्यक्तवर्गरुपैयुक्तौ पक्षौ ततो मूलम् ।।
অর্থাৎ কিনা, 'যদি একটি সমীকরণ ax^2+bx=c হয়, তবে অজ্ঞাতরাশি x টিকে বার করতে হলে আমাদের প্রথমে উভয়পক্ষে 4a দিয়ে গুণ করতে হবে। তারপর সমীকরণের দুদিকেই b^2 যোগ করতে হবে। শেষে আমাদের একটা বর্গমূল নিতে হবে।' ঠিক এইরকমই আমরা শিখেছিলাম স্কুলে। অজিতবাবু তাই বলেছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ধরনের দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধান করে আমরা দুইটি উত্তর পেতাম । কিন্তু শ্রীধর আচার্য এই দুইটি ফলের উল্লেখ করেছিলেন কিনা সেটা সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন করেছিলেন। কেউ বলেন করেন নি।
যাইহোক, শুধু ভাস্করাচার্যই যে শ্রীধরের এই দ্বিঘাত সমীকরণ সূত্রের কথা বলেছেন এমনটা নয়। জ্ঞানরাজা (১৫০৩ খ্রী), সূর্যদাস (১৫৪১ খ্রী), কৃষ্ণ (১৫৮০ খ্রী), রামকৃষ্ণ (১৬৪৮ খ্রী) প্রভৃতি গণিতবিদরাও এই শ্রীধরের এই সূত্রের কথা উল্লেখ করে গেছেন। 'বীজগণিত' বইটির শেষে ভাস্করাচার্য বলেন- 'যেহেতু ব্রহ্মগুপ্ত, শ্রীধর এবং পদ্মনাভ প্রভৃতি গণিতবিদদের কাজের ব্যাপ্তি বিশাল, তাই ছাত্রদের সুবিধার্থে তাঁদের কাজের কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত করে এই বইয়ে দিলাম।' শ্রীধরের মূল 'বীজগণিত' বইটিতে না জানি আরও কত সূত্র থাকতে পারে! সেটি আমরা কি জানতে পারব কোনদিন? কোথাও কি মূল সেই বইটির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে?
বেলা গড়িয়ে এসেছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে চোখ বেশি চলে না। তাই বইটা তুলে রাখলাম। কফি খাওয়ার সময় হয়েছে। একটু পরে কমলবাবু ফোন করলেন। কমলবাবু শ্যামপুর স্কুলের শিক্ষক। এই শ্রীধর আচার্যের অভিযান নিয়েও তিনিও বেশ উৎসাহিত দেখলাম। আমায় এই বিষয়ে নানাভাবে সাহায্য করেন। বললেন - 'আমাদের সোমনাথ বাবু, শ্যামপুর স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন একসময়। ডিহিভুরশুট গ্রামের ভূমিপুত্র। উনি ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে এসেছেন বোধ হয়। একবার ফোন করে দেখতে পার, আচার্যের ভিটে নিয়ে উনি কিছু বলতে পারেন কিনা।'
আমি বললাম - করব।
***
পরদিন যথারীতি আমি সোমনাথ বাবুকে ফোন করলাম। প্রথমেই আমার পরিচয় দিলাম। শুনে উনি বললেন - 'ভালো। বিদেশে পড়াশোনা করছ। ভাল। তা তোমাদের হেড মাস্টার কি সলিল চৌধুরী ছিলেন? আমি বললাম - না। সলিলবাবু আমাদের পরে জয়েন করেছিলেন। আমাদের সময়ে অনিলবাবু ছিলেন হেড মাস্টার। অনিলচন্দ্র ঘোষ।' এইরকম এটা সেটা কথা হবার পর আমি আসল কথাটা পাড়লাম। বললাম - 'আপনার বাড়ির পাশে যে ভিটেটা রয়েছে, সেটা কি গণিতজ্ঞ শ্রীধর আচার্যের বাড়ি ছিল এককালে? আসলে আমি কিছুদিন আগে ওখানে গিয়েছিলাম। আপনি তখন বোধ হয় বাইরে ছিলেন। তাই দেখা করার সুযোগ হয়নি। আমি শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটা বই লিখছি। তাই কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি। আপনি কি কিছু জানেন এ ব্যাপারে?'
সোমনাথ বাবু বললেন - 'ও, হ্যাঁ, ওই ভিটেটা। ওটা কোন এক আচার্যের ভিটে ছিল বটে। কিন্তু ওই আচার্য শ্রীধর আচার্য ছিলেন কিনা সেটা বলা মুশকিল। অনেকদিন ধরেই জায়গাটা ওইভাবে পড়ে আছে।'
আমি বললাম - 'তো এখন ওই জায়গার মালিক কে? আচার্যদের বংশধরদের কোন খোঁজ জানেন?'
সোমনাথ বাবু বললেন - ' যতদূর জানি, বংশধররা জায়গাটা গ্রামের কাউকে বিক্রি করে শহরে উঠে গেছে। তাদের খবর তো বলতে পারব না।'
ভিটের বংশধররা যে এখন কোলকাতার বাসিন্দা সেটা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু ভিটেটা গ্রামের কারো কাছে বিক্রি হয়ে আছে সেটা জানতাম না। ভিটেটার বর্তমান মালিক কে সেই সম্পর্কে সোমনাথবাবুও কোন আলোকপাত করতে পারলেন না। হয়ত লাইব্রেরিয়ান প্রশান্তবাবু জানবেন। সোমনাথবাবু শেষে বললেন - 'তুমি যদি এই ভিটের উত্তরাধিকারদের খোঁজ পেয়েও যাও, এখন ফুটেজ খাওয়ার জন্য অনেকেই বলতে পারেন যে এই আচার্যই সেই শ্রীধর আচার্য ছিলেন। কিন্তু সেটা প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে। তাই না? বক্তিয়ার খিলজির আক্রমণের আগে বাংলার ইতিহাস তো খুব একটা ভালো করে লেখা নেই। অনেকটাই ধোঁয়াশা। তাই তুমি যে কাজটা নিয়েছ, সেটা কঠিন।'
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। সোমনাথ বাবু আমায় একটু উৎসাহিত করে বললেন - 'কিন্তু শ্রীধর আচার্য নিয়ে গবেষণা চলতে থাকুক। দেখা যাক কি খুঁজে পাও। আমি তোমার পাশে আছি।'
শেষের কথাটা শুনে আমার ভালো লাগল। যেকোন ধরনের গবেষণায় একটা 'healthy level of skeptisism' খুব দরকার। কোনকিছুকেই 'face value' তে গ্রহণ করতে নেই। আগে দেখা দরকার কোন তথ্য ঠিকঠাক আগের তথ্যের সাথে খাপ খাচ্ছে কিনা তবেই সেটা সত্য বলে মানতে হয়। এই ধরা যাক আমাদের রসায়নে। কোন একটা যৌগের গঠন জানতে আমরা অনেকরকম পদ্ধতির প্রয়োগ করি। কোনটা ম্যাগনেটিক রেসোনান্স, কোনটা আবার ইলেক্ট্রনিক রেসোনান্স। রামান পিক। ইনফ্রা রেড পিক। সব কিছু পদ্ধতি একই রকমের যৌগের কথা বললে তবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। সোমনাথবাবু আমায় সেই পথেরই নিশানা দিলেন। আমার এখন কাজ যেসব তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে বা ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে সেগুলোর সঠিক এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এই যে আচার্যের ভিটেটা দেখছি সেটা শ্রীধর আচার্যের ভিটে নাও হতে পারে। কে জানে!
তবে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে এই ভিটে শ্রীধর আচার্যেরই। 'gut feelings' তাই বলছে। কেননা এই ডিহিভুরসুট গ্রামের আগের নাম ছিল 'ভুরসুট' - যা কিনা শ্রীধর আচার্যের গ্রাম। আর এখানেই পাওয়া গেল আচার্যের ভিটে। এটা নিছক কাকতালীয় হবার সম্ভাবনা কম। তবে আমাদের এই ডিহিভুরশুটের শ্রীধর আচার্য যে দ্বিঘাত সমীকরণখ্যাত গণিতজ্ঞ শ্রীধর আচার্য, সেই নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। শ্রীধর আচার্য সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় যা লেখা আছে তা হল - তিনি অতীতের 'ভুরশুট' গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং তাঁর লেখা বইগুলি হল- বীজগণিত, পাটিগণিতসার (ত্রিশতিকা, যে বইটি আমি ইদানীং পড়ছি), নভসতি, ইত্যাদি। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল এই বইগুলির সবগুলোই অঙ্কের বই। কিন্তু আমাদের লাইব্রেরিয়ান প্রশান্তবাবু আরেকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছিলেন যেটির নাম 'ন্যায়কুণ্ডলী'। সেটির নাম উইকিপিডিয়ায় নেই। এই ন্যায়কুন্ডলী বইটি মূলত দর্শনশাস্ত্রের বই। অঙ্কের নয়। নীহাররঞ্জন রায়ের"বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)" বইতেও যে শ্রীধর আচার্যের কথা রয়েছে তিনি 'ন্যায়কুন্ডলী' বইটি লিখেছেন। কিন্তু অঙ্ক বইগুলি লিখেছেন কিনা তার বিবরণ দেন নি নীহারবাবু।
আচ্ছা, এমনটাও তো হতে পারে যে অতীতে দুইজন শ্রীধর আচার্য ছিলেন! একজন গণিতজ্ঞ, যিনি দ্বিঘাত সমীকরণের সূত্র দিয়েছিলেন। আর একজন দর্শন শাস্ত্রের পণ্ডিত। যিনি 'ন্যায়কুণ্ডলী' বইটি লিখেছেন। যেমন আছেন প্রথম এবং দ্বিতীয় আর্যভট্ট। প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য। তেমনটি কি প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রীধর আচার্যও থাকতে পারেন? নাকি 'ন্যায়কুন্ডলী' এবং 'ত্রিশতিকা' র লেখক একজনই? এক এবং অদ্বিতীয় শ্রীধর আচার্য! কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
***
নীহার বাবুর বইটা আবার হাতে নিলাম।
নীহার রঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' বইয়ে লিখছেন যে প্রাচীন বাংলায় অধ্যান্তচিন্তা এবং দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে লেখালিখি করে যিনি সবথেকে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি হলেন 'ভূরিশ্রেষ্ঠী' (অধুনা ডিহুভুরশুট?) গ্রামের শ্রীধর-ভট্ট। বেদ-বেদান্ত এবং বিভিন্ন দর্শনচর্চা নাকি বাংলায় তখনও হত। শ্রীধর 'ন্যায়কন্দলী' ছাড়াও আরও কিছু বই লিখে গিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। অদ্বয়সিদ্ধি, তত্ত্বপ্রবোধ, তত্ত্বসংবাদিনী এবং সংগ্রহটিকা নামে চারখানা বেদান্ত এবং মীমাংসা বিষয়ক পুঁথি তিনি রচনা করেছিলেন। সবগুলিই দর্শনশাস্ত্রের। কিন্তু সেই সব লেখা কালের ইতিহাসে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে বৈদেশিক আক্রমণে।
সোমনাথ বাবু বলেছিলেন বাংলায় খলজি আক্রমণের কথা। তার আগের বাংলার ইতিহাস কেমন যেন কুয়াশায় ঢাকা। আবছা। বক্তিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করেন আনুমানিক ১২০৩ সালে। তখন বাংলার লক্ষণ সেনের পড়তি অবস্থা। আঠারোটি সেনা নিয়ে নবদ্বীপ দখল করে নিলেন বক্তিয়ার। একে একে বাংলার অন্য নগরগুলিও চলে এলো তাঁর দখলে। জয় করলেন বাংলার রাজধানী গৌড়। খলজির আক্রমণের হাত ধরেই এল বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্কট। শশাঙ্কের আমলে হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্মের তেমন সাঙ্ঘাতিক কোনরূপ বিভেদ ঘটেনি। কিন্তু খলজির আক্রমণে বিশেষ করে বৌদ্ধমঠগুলির বেশ ক্ষয়ক্ষতি শুরু হল। উত্তর বাংলার বৌদ্ধমঠগুলি ছিল উচ্চতর জ্ঞানার্জনের পীঠস্থান। মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খলজি এবং তার সেনাপতি সুবাদার আওালিয়া খান একে একে সেই মঠগুলিতে হানা দিতে থাকল।পুড়তে থাকল অমূল্য সব পুঁথি। অকাতরে নিধন হতে থাকলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।
এইরকমই এক অসহায় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন প্রশস্তপাদ। প্রশস্তপাদের লেখা পদার্থ-ধর্ম-সংগ্রহ নামক ভাষ্যের টীকা হিসাবে 'ন্যায়কন্দলী' রচনা করেছিলেন শ্রীধর। তবে বাংলায় এই বই জনপ্রিয় হয়েছিল বলে তেমন জানা যায় নি। এই বই নিয়ে তেমন আলোচনা বাংলায় হয়নি। মৈথিলী পণ্ডিত পদ্মনাভ এবং রাজশেখর নামে পশ্চিম ভারতের কোন এক জৈন আচার্য 'ন্যায়কন্দলী' নিয়ে কিছু লিখেছিলেন। এই যা। বাংলায় তেমন কিছু হয় নি।
যাই হোক নীহার বাবু লিখছেন - শ্রীধরের ন্যায়কন্দলীর রচনা আনুমানিক ৯১০ বা ৯১৩ শকে। তার পিতার নাম ছিল বলদেব। মাতার নাম ছিল অভ্রোকা বা আব্বোকা। কিন্তু তিনি শ্রীধরের গণিত চর্চার কথা বলেন নি। কোন গণিত সম্পর্কিত বই লিখেছিলেন কিনা তারও উল্লেখ করেন নি। তাই আমার ধারণা হচ্ছে বর্তমান ডিহুভুরশুটের যিনি শ্রীধর ছিলেন, তাকে আপাতত দার্শনিক বলাই ভালো। তাঁকে অঙ্কের লোক বলে এখনো কোন অকাট্য প্রমাণ পাচ্ছি না। এই দার্শনিক শ্রীধরকে এখন থেকে 'শ্রীধর ভট্ট' বলে চিহ্নিত করলাম। আর আমাদের দ্বিঘাত সমীকরণের উদ্ভাবক গণিতবিদ শ্রীধরকে 'শ্রীধর আচার্য' হিসাবে চিহ্নিত করলাম। যাতে গুলিয়ে না ফেলি। কিন্তু উইকিপিডিয়া বোধ হয় গুলিয়ে ফেলেছে। গণিতবিদ শ্রীধর আচার্যের পিতামাতার নাম বলদেব এবং অভ্রোকা বলে দাবী করেছে। উইকিপিডিয়া কি ভুল? সময়ই বলবে।
শ্রীধর আচার্য এবং শ্রীধর ভট্ট, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক - এই দুই ব্যক্তির সম্পর্কে রহস্যভেদ করতে আমার রজত চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলা বেশ দরকার বলে মনে হল। সেই রজত চক্রবর্তী, যিনি উনিশ শো সাতানব্বই সালে ডিহিভুরশুট থেকে খনন করে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি যাদবপুরের আরকিওলজি বিভাগের প্রফেসর। কিন্তু ইন্টারনেটে খোঁজ করে এনার কিছু খবর পেলাম না। আমার এক বন্ধু সিতাংশু যাদবপুর থেকে ব্যাচেলর্স করেছে। একদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে সিতাংশুকে ফোন করলাম। বললাম - 'আরকিওলজি বিভাগের রজত মুখার্জির খোঁজ দিতে হবে।'
সিতাংশু বলল - 'যাদবপুরে জিওলজি ডিপার্টমেন্ট আছে বলে জানি। কিন্তু আরকিওলজি আছে কিনা তো জানি না। আচ্ছা আমি খোঁজ নিয়ে বলব।'
কিছুদিন পর সিতাংশুর ফোন পেলাম। সিতাংশু বলল - 'না ভাই। যাদবপুরে আরকিওলজি ডিপার্টমেন্ট নেই। আর জিওলজি বিভাগেও রজত চক্রবর্তি বলে কেউ নেই।'
ভারি মুশকিলে পড়া গেল। এখন রজত চক্রবর্তীকে পাই কোথাই? শান্তনীড় লাইব্রেরীর সুশান্তবাবু কি তাহলে আমায় ভুল বলেছিলেন? আরেকবার ওনার সাথে কথা বলতে হবে দেখছি। আর আপনাদের এই বিষয়ে কিছু সন্ধান থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি সুশান্তবাবুকে ফোন করব। কিন্তু করা হচ্ছে না। অফিসে কাজের চাপ অনেক জমে গিয়েছিল। ছেলের স্কুল। তার মাঝে কিছু জব ইন্টারভিউও ছিল এদিক সেদিক। এত কিছুর মাঝে শরীর বেশ ক্লান্ত লাগত। সেদিন তারই মধ্যে একটু বিশ্রাম পেলাম। বেশ কিছুদিন হল আমার কর্মক্ষেত্র ইজরায়েলে ফিরে এসেছি। এসেও ঝামেলার শেষ নেই। প্রথমে মাঝে মাঝেই যুদ্ধের সাইরেন বেজে উঠত। এখন তবু একটু ঠাণ্ডা। কিন্তু যাক সে কথা। পরে একদিন সেসব গুছিয়ে বলা যাবে।
এখানে শীতকালে আবার বৃষ্টি বেশি হয়। ভূমধ্যসাগর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে আসছে। অফিসে বসে একটা কফি বানালাম। তারপর ফোন করলাম। কিছুক্ষণ রিং হবার পর সুশান্তবাবু ফোন ধরলেন। আমি পরিচয় দিলাম। কিন্তু উনি শুনতে পেলেন না ভালো করে। বললেন - 'কে? কমল বাবু?'
আমি বললাম - 'না। আমার নাম প্রেমাশিস। আমি শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটা বই লিখছি। সেই বিষয়ে কিছু জানতে চাই। আপনার বাড়ি গিয়েছিলাম। আপনার স্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু আপনার সাথে হয় নি।'
সুশান্তবাবু বললেন- 'কি বলছেন কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ফোনটা বড় ডিস্টার্ব করছে। কে? মুরারী বাগ?' কখনো কমল বলে, কখনো মুরারী বাগ। কি মুশকিল! আমি ভাবলাম বলি যে আমি বাঘ ভাল্লুক কেউ নই। মানুষ। কিন্তু কৃষ্ণর কথা মনে পড়ল। সে বলেছিল সুশান্তবাবু একটু বাইরে ভীষণ কঠিন হলেও, মানুষটা বেশ আদর্শবান। আমি একটু কষ্ট করে কথা চালানোর চেষ্টা করলাম। অফিস থেকে একটু বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে আবার কথাগুলো বললাম। যাতে নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়। তাতেই কাজ হল। এইবার বোধ হয় সুশান্তবাবু শুনতে পেলেন। বললেন - 'না কেউ তো আমার কাছে আসে নি। কি বলবেন বলুন।'
আমি বললাম - 'আপনি যে বলেছিলেন রজত চক্রবর্তীর কথা। রজত চক্রবর্তী। যিনি যাদবপুরের প্রোফেসর। তাঁকে তো খুঁজে পাচ্ছি না। তার বাড়ি কোথায়? তারকেশ্বরের দিকে কি?'
সুশান্তবাবু বললেন - তারকেশ্বরের দিকে নয়। তারকেশ্বরেই।
আমি বললাম - 'তিনি যে শ্রীধরের ভিটে থেকে কিছু খুঁড়ে নিয়ে গেছেন। তার কি হল?'
তিনি বোধ হয় আবার শুনতে পেলেন না। বললেন - 'হ্যাঁ! রজত চক্রবর্তী। সে তো এসেছিল। রজতকে বলেছিলাম গবেষণা পত্রের একটা আমার কাছে দিয়ে যেতে আর একটা পাঠাগারে রেখে যেতে। সে তো কথা রাখেনি।'
আমি বুঝলাম এই ভাবে কথা বেশিদূর এগোচ্ছে না। ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। তারকেশ্বর। রজত চক্রবর্তী। যাদবপুর। এর মধ্যেই যেন রহস্যটা আটকে আছে। কিছুতেই বেরুতে পারছে না। আমি বললাম - 'তারকেশ্বরের কোথায় জানেন রজত চক্রবর্তীর বাড়ি?'
তিনি বললেন - না। 'আচ্ছা। ভালো থাকবেন' বলেই খপ করে ফোনটা রেখে দিলেন। যা বাব্বা!
আজ কাজ তেমন কিছু এগুলো না। তারকেশ্বরে যদি রজত চক্রবর্তীর বাড়ি হয়, তাহলে খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। আমার এক পরিচিত কল্যাণকাকুর বাড়িও ওইদিকে। তাকে একটু লিখলাম। যদি জেনে থাকে। কল্যাণকাকু বলল সে হাওড়া স্টেশনে। মধ্যপ্রদেশ যাচ্ছে। সেখানে একটা আদিবাসী গ্রামের গরীব ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমাজ সেবামূলক কাজে। এরকম মানুষ খুব কমই দেখেছি। কাজপাগল মানুষ। ‘কল্যাণকাকু’ বললে রেগে যায়। বলে - শুধু 'কাকু' বলবি। আমি কি পর? মানুষকে খুব ভালবাসেন। যাইহোক, কাকু বলল - 'আমি খোঁজ নিয়ে দেখব, রজত চক্রবর্তী বলে কেউ আছে নাকি। মনে হয় পেয়ে যাব বুঝলি, বাপ। টেনশন নিস না।' শুনে একটু আশ্বস্ত হলাম।
এদিকে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এল। সকালে রোদ্দুর ছিল। তাই ছাতাটা আনিনি।এখন বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিতে বাড়ি ফিরি কিভাবে তাই ভাবতে লাগলাম। এই বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দি-কাশি নির্ঘাৎ কিছু একটু বাঁধাব। আকাশে একটা যুদ্ধবিমান গোঁ গোঁ শব্দে উড়ে গেল। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে জল পড়ছে। টুপটুপ। একটা শালিক পাখি রাস্তায় কেঁচো ধরে খাচ্ছে। আমি এই বিদেশবিভূঁইয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে চলে গেলাম বহুকাল আগের প্রাচীন ভারতে... শ্রীধর আচার্যের সময়ে। আচার্য লিখছেন তার পাটিগণিত বইয়ের প্রথম শ্লোকটি -
नत्वा शिवं स्वविरचितपादया गणितस्य सारमुद्वृत्य।
लोकव्यवहाराय प्रवक्ष्यति श्रीधराचाये।।
অর্থাৎ কিনা - আমি শ্রীধর আচার্য, ভগবান শিবের চরণে মাথা রেখে পাটিগণিতের মূল সূত্রগুলি এইখানে লিপিবদ্ধ করে রাখছি। যাতে সাধারণ মানুষের কাজে লাগে।
আচ্ছা, শ্রীধর আচার্য কি তবে শৈব ছিলেন? সে নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিকরা কোন কিছুতেই কি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না?
শ্রীধর আচার্য যে শিবের উপাসক ছিলেন না প্রথম সেই বিষয়ে যুক্তি দেখান এন. সি. জৈন নামক এক ভদ্রলোক।
তিনি কর্নাটকের একটি জৈন গ্রন্থাগার থেকে তাল-পাতায় লেখা শ্রীধরের 'ত্রিশতিকা' গ্রন্থের একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। পুঁথিটি লেখা ছিল কন্নড় ভাষায়। 'ত্রিশতিকা'র এই সংস্করণটিতে শুরুর শ্লোকটি জৈন দেবতার উদ্দেশ্য নিবেদিত। শিব বা মহাদেবের উদ্দেশ্যে নয়। শ্লোকটিতে 'শিবম' এর জায়গায় রয়েছে 'জিনম'। ব্যাস! এখানেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। এন. সি. জৈন তখন দাবী করে বসলেন শ্রীধর আসলে জৈন ছিলেন। আর এই কন্নড় ভাষায় লেখা 'ত্রিশতিকা' সংস্করণটিই তার প্রমাণ। শুধু তাই নয়। তিনি এও দাবী করেন উত্তর ভারতে প্রকাশিত 'ত্রিশতিকা' বইটির সম্পাদক সুধাকর দুবে মহাশয় ইচ্ছাকৃত ভাবে 'জিনম' এর জায়গায় 'শিবম' ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এটি একটি মারাত্মক আরোপ! বিজ্ঞানে যেরকম 'ডেটা ম্যানিপুলেশন' হয়, সেই রকম আর কি। যদি প্রমাণিত হয় তবে দুবেজীর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবন কালিমালিপ্ত হতে পারত, সেই সম্পর্কে কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় নি।
কৃপাশঙ্কর শুক্লা (উত্তর ভারতীয়?) নামক আর একজন লেখক এন. সি. জৈনর ওই যুক্তিকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। শ্রীধর যে একজন সাত্ত্বিক শৈব ছিলেন, জৈন ছিলেন না, তার সপক্ষে তিনি চারটি যুক্তি দেখান -
১) কর্নাটকের জৈন লাইব্রেরীর 'ত্রিশতিকা' ছাড়া এই বইয়ের আর যে সংস্করণগুলি পাওয়া গেছে, তাতে প্রথম শ্লোকটিতে শিবেরই উল্লেখ রয়েছে। জৈন দেবতার নয়। সুতরাং কন্নড় ভাষার 'ত্রিশতিকা' সংস্করণটিকে একরকম ব্যতিক্রম ধরাই ভাল।
২) 'ত্রিশতিকা' হল শ্রীধরের 'পাটিগণিত' বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। মূল 'পাটিগণিত' বইয়ে শ্রীধর এক 'অজাত ভগবানের' (Unborn God) উল্লেখ করেন যাকে মহাদেব বা শিবের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এই ভগবানের পাঁচটি ক্রিয়ার (পঞ্চকৃত্য) কথা তিনি বলেন - সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, অনুগ্রহ, এবং তিরোধন -
पञ्चविधं तत्कृत्यं सृष्टिस्थितिसंहारतिरोभावाः।
तद्वदनुग्रहकरणं प्रोत्कं सततोदितस्यास्य।
৩) মূল 'পাটিগণিত' বইয়ে একটি জায়গায় পাটিগণিত অধ্যয়নকে শিবের পঞ্চমুখের উপাসনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
৪) এন. সি. জৈনর আবিষ্কৃত কন্নড় পাণ্ডুলিপি বেশ গোলমাল ছিল। সেই পাণ্ডুলিপিতে অনেক নতুন সূত্র সংযোগ করা হয় যা ত্রিশতিকার অন্য সংস্করণগুলিতে ছিল না। তার ওপর কিছু কিছু জায়গায় জৈন দেবতার উল্লেখ ছিল যা কেবলমাত্র ঐ জৈন লাইব্রেরীর পাণ্ডুলিপিটাতেই পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই মূল সূত্রগুলিরও অল্পবিস্তর পরিবর্তন করা হয়।
এইসব কারণে অনেকেই এন. সি. জৈনর 'জৈন শ্রীধরাচার্য' হাইপোথিসিস অনেকেই মানতে চান না। তবে অধ্যাপক আর. সি. গুপ্ত এই বিবাদের একটা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন যে এটা হতে পারে শ্রীধর আচার্য তার গণিত বিষয়ে কাজগুলি করার সময় সাত্ত্বিক শৈব ছিলেন। কিন্তু তাঁর শেষ জীবনে তিনি জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি শ্রীধর আচার্য জৈন ছিলেন বা শৈব ছিলেন তাতে কিছু একটা এসে যায় না। সে নিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভালো। যেটা প্রধান ব্যাপার সেটা হল তাঁর গাণিতিক সূত্রাবলী। তাঁর কাজ। কাজ দিয়েই মানুষ চেনা উচিৎ। ধর্ম দিয়ে নয়। ধর্ম খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে হাত না দেওয়াই ভাল। এই বিষয়ে আমার একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
পিয়ের সাইমন ল্যাপলাস ছিলেন এক ফরাসী গণিতজ্ঞ। তাঁকে কেবল গণিতজ্ঞ বললে ভুল হবে। ল্যাপলাস সম্ভাবনা তত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যাতেও অনেক অবদান রেখে গেছেন। তিনি Celestial Mechanics এর ওপর পাঁচখানি বই লিখে যান। যেখানে তিনি গ্রহ নক্ষত্র কেমন করে কাজ করে সেই সম্পর্কে লিখে যান। ঘটনাটি ঘটে আনুমানিক ১৮০২ সালে - যখন ল্যাপলাস Celestial Mechanics এর তৃতীয় খণ্ডটি প্রকাশ করেন। তখন ফরাসী দেশে নেপোলিয়নের রাজত্ব চলছে। নেপোলিয়ন একদিন ল্যাপলাসকে ডেকে পাঠালেন। বললেন - 'শুনলাম, তুমি নাকি আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কেমন করে চলছে সেই নিয়ে একটা মোটা বই লিখেছে। ভালো কথা। কিন্তু সেই বইয়ে ঈশ্বরের কথা তো উল্লেখ কর নি। ঈশ্বর না চালালে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড চলবে কি করে?' সম্রাটের মুখে এই কথা শুনে ল্যাপলাস হতবাক হলেন। কিন্তু তাঁকে না চটিয়ে বললেন - 'Je n'avais pas besoin de cette hypothèse-là.' অর্থাৎ - 'স্যার, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চালাতে আমার 'ঈশ্বর হাইপোথিসিসে'র প্রয়োজন হয়নি!' অয়লার থেকে নিউটন যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের 'harmony' কে ভগবানের অবদান বলে মনে করতেন, তখন ল্যাপলাসের এই উক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন। অনেকটা আধুনিকও বলা যেতে পারে।
কিন্তু আমরা বলছি শ্রীধর আচার্যের কথা। অষ্টম-নবম শতাব্দীর কথা। সেই সময় বৈজ্ঞানিক কাজেও ভগবানের প্রবেশ এমন কিছু আশ্চর্যের নয়। তার ওপর আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে যেকোন ধরনের কার্যকলাপ শুরু করার আগে গুরু বা আরাধ্য দেবতার নাম নেওয়ার একটা প্রচলন আছে। শ্রীধর সেই নিয়মেরই পালন করেছেন। ছোটবেলায় গ্রামে কালীপূজা উপলক্ষে কোন কোন বছর তর্জা গানের আয়োজন হত। সেখানে দেখতাম গায়ক তাঁর গান শুরু করার আগে গানের মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ তাঁর আরাধ্য দেবতা বা গুরুর সুনাম করতেন। কয়েকবছর আগেও সিনেমা শুরু করার আগে ঠাকুর দেবতার ছবি দেখানো হত। ভারতে কোন কোন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এখনো প্রদীপ প্রজ্বলনের প্রথা আছে। যদিও এটা খুব একটা ধর্ম নিরপেক্ষ নয়। কিছুদিন আগে ইউটিউবে তবলা ম্যস্ট্রো জাকির হুসেনের তবলা শুনলাম। সেখানেও দেখলাম হুসেন সাহেব তবলায় তাল ঠোঁকার আগে কানে একবার হাত দিলেন। তাঁর গুরুকে প্রণাম জানাতে। সেই প্রাচীন ভারতীয় রীতি মেনেই শ্রীধর আচার্য তাঁর আরাধ্য দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে শুরু করেছেন তাঁর বইটি।
বৃষ্টি কিছুক্ষণ থেমে ছিল। পশ্চিম আকাশ তবু কালো মেঘে ঢাকা। হু হু হাওয়া তখনও বয়ে আসছে। না জানি আবার কখন বৃষ্টি শুরু হয়। আমি গুটি গুটি পায়ে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।
ডিহিভুরশুটের লাইব্রেরিয়ান সুশান্ত ভারতীর কাছে যখন শ্রীধর আচার্যের কথা জানতে চাই, তিনি ‘ন্যায়কন্দলী’ নামের বইটির কথা বলেছিলেন। অধ্যাপক অচল ভট্টাচার্যের লেখা 'হাওড়া জেলার ইতিহাস' বইটিতেও এই 'ন্যায়কন্দলী' বইয়ের উল্লেখ আছে। ভাবলাম এই প্রাচীন বইটি সংগ্রহ না করলেই নয়। না হলে আচার্য নিয়ে আমার গবেষণা অসম্পূর্ন থেকে যাবে। এই বই থেকে আচার্যে সম্পর্কে অনেক কথা জানা যেতে পারে। শ্রীধর আচার্যের ‘ত্রিশতিকা’ বইটি ইতিমধ্যেই আমাজন থেকে কিনেছিলাম। কিন্তু ‘ন্যায়কুণ্ডলী’ বইটি ইন্টারনেটে নেই। থাকবেই কি করে? বেশ পুরানো বই। তবে এই বই পাই কোথা থেকে?
তার সন্ধান দিয়েছিলেন সুশান্ত বাবুই। বলেছিলেন 'এশিয়াটিক সোসাইটি' র লাইব্রেরীতে শ্রীধরের লেখা এই বইটি পেতে পারি। শুধু একটা মেম্বারসিপ করাতে হবে। এই আর কি! এশিয়াটিক সোসাইটির বর্তমান ঠিকানা - ১, পার্ক স্ট্রীট, কোলকাতা - ৭০০০১৬। আমার দেশের বাড়ি হুগলী থেকে পার্ক স্ট্রীট ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা হবে। বেশি দূর নয়। সকালের তারকেশ্বর লোকালে হাওড়া। সেখান থেকে ২০৮ নম্বর বাসে পার্ক স্ট্রীট। কিন্তু আমি তো এখন ইজরায়েলে কাজে ফিরে এসেছি। পার্ক স্ট্রীট যাওয়ার উপায় নেই। কাউকে আমার হয়ে যেতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম ওদের একটা ইমেইল করলে কেমন হয়!
ইন্টারনেটের এশিয়াটিক সোসাইটির ওয়েবসাইট পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না ।
https://www.asiaticsocietykolkata.org/ তাদের ওয়েবসাইটে বিরল কিছু বইয়ের লিস্ট দেখে বেশ আশ্চর্যই হলাম। সব থেকে পুরানো যে পাণ্ডুলিপিটি রয়েছে সেটি সপ্তম শতাব্দীর। তন্ত্র বিষয়ক। নাম - 'কুব্জিকামাতাম' (সেটা আবার কি?)। তারপরেও রয়েছে ষোলশ শতাব্দীর Delle Navigationi Et Viaggi Venice, শতেরশ শতাব্দীর ওল্ড টেস্টামেন্টের আরবী অনুবাদ - Turait-I-Musa-An-Nabi, আঠারশো শতাব্দীর লেখা অথর্ববেদের একটা সংস্করণ, N. Halhed’s Grammar of the Bengal Language ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু এদের মধ্যে শ্রীধরের লেখা 'ন্যায়কুন্ডলী' দেখলাম না। কিছুটা আশাহত হয়েই ইমেলে লিখলাম - মহাশয়, আমার নাম প্রেমাশিস। আমি শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটি বই লিখছি। যদি আপনাদের কাছে 'ন্যায়কুন্ডলী' র কিছু খণ্ড থেকে থাকে তবে বড়ই উপকৃত হই।
ভেবেছিলাম কিছু উত্তর পাব না। আজকাল কে আর অচেনা লোকের উত্তর দেয়। তাও ভারতে থেকে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিশেষত সরকারী চাকুরীজীবীদের দেখে। তাদের দর্শন – ‘আসি যাই মাইনে পাই। কাজ করলে উপরি চাই।‘ লোকজন মোটের ওপর ভীষণ অপেশাদার, unprofessionalযাকে বলে আর কি! আমার স্ত্রীর পাস্পোর্ট করাতে গিয়ে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল এককালে। কিন্তু আমার সকল ঋণাত্মক চিন্তায় জল ঢেলে দিয়ে দুতিন দিন পরেই এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে উত্তর পেলাম –
“মহাশয়, আমাদের কাছে ‘ন্যায়কুন্ডলী’র উপর তিনটি বই রয়েছে। সেগুলি হল -
১) শ্রীধরের ন্যায়কুন্ডলী এবং প্রসস্তপাদের পদার্থধর্মসংগ্রহ (গঙ্গাধর ঝা কতৃক ইংরাজিতে অনুবাদিত), বারানসী (১৯৮২)
২) মুনি প্রসস্তপাদের প্রশস্তপাদভাস্যম (শ্রীধরাচার্যের 'ন্যায়কুন্ডলী' ভাষ্যসহ), বারানসী, ১৮৯৫
৩) প্রসস্তপাদভাষ্য/ প্রশস্তপাদ আচার্য ( শ্রীধর ভট্টের 'ন্যায়কুন্ডলী' ভাষ্যসহ), বারানসী, ১৯৭৭ “
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল সব কটি বইই বারানসী থেকে প্রকাশিত। আর একটি দেখার বিষয় হল - কখনো কখনো ন্যায়কুন্ডলীর লেখককে শ্রীধর আচার্য বলা হয়েছে। আবার কখনো কখনো শ্রীধর ভট্ট। যাইহোক, এশিয়াটিক সোসাইটি জানাল যে তারা আমায় বইগুলো স্ক্যান করে ইমেলে পাঠাতে পারবে। তবে হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে। ফি।
আমি তাদের লিখলাম – ‘ঠিক আছে। টাকা দিতে আমি রাজি। আপনারা বইগুলি অবিলম্বে পাঠান।‘
এত দিনের পুরানো বইগুলো থেকে আচার্য সম্পর্কে কি আবিষ্কার করব তাই নিয়ে অধীর আগ্রহে দিন কাটাতে লাগলাম। দুদিন গেল। তারপর এক সপ্তাহ। শেষে এক মাস কেটে গেল। এশিয়াটিক সোসাইটি শ্রীধরের লেখা বই আর পাঠায় না! এই রে! কিছু স্ক্যামের চক্করে পড়লাম নাকি?
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শ্রীধরের লেখা বইটির জন্য যখন অপেক্ষা করছি। ভাবলাম ঠিকঠাক জায়গায় টাকাটা পাঠালাম তো? ভালো করে আবার ওদের ওয়েবসাইটে চোখ বোলালাম। হ্যাঁ, এই তো। The Asiatic Society, An Institute of National Importance declare by an Act of Parliament under Ministry of Culture, Govt. of India. সরকারী ওয়েবসাইট। স্ক্যাম হবার সম্ভাবনা কম। জ্বলজ্বল করছে বাদামি রঙের স্যার উইলিয়াম জোন্সের ছবিটা।
কিছুকাল আগেই সুব্রত দাশগুপ্তর লেখা ‘Awakening’ বইটা পড়েছিলাম। এখানে বাংলার নবজাগরণের কথা বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যসাগর থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, জগদীশ বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কথা রয়েছে। আর রয়েছে কিছু ইংরেজের কথাও। যারা এই দেশে ভালো কিছু করার কথা ভেবেছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। বাংলায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা।
১৭৮৪ সালের ১৫ ই জানুয়ারি। কোলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে প্রায় তিরিশ জন ভদ্রলোক জমায়েত হন। এদের কেউই ভারতীয় ছিলেন না। ভদ্রলোকেরা স্থির করলেন একটি সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করবেন। এই সোসাইটির উদ্দেশ্য কি হবে? উদ্দেশ্য হবে প্রাচীন এশিয়ার ইতিহাস, স্থাপত্য, কলা, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের অনুসন্ধান করা। নাম রাখা হল - Asiatick Society. ব্রিটেনে যেমন Royal Society র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই আদলেই এই এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা। সেই তিরিশ জন ভদ্রলোকের মধ্যে মধ্যমণি ছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্স। এই সোসাইটি বানানোর ইচ্ছা জোন্স সাহেবের মনে আসে অনেকদিন আগেই। তিনি তখন ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত।
ছাত্রাবস্থায় উইলিয়াম জোন্স যে কজন কবি-দার্শনিকদের ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সিসেরো, মিল্টন, বায়রন, ইউক্লিড প্রভৃতিরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তার কাছে তাই ভুল মানে ভুল, সত্যি মানে সত্যি। জ্ঞান মানে জ্ঞান। সে যে সভ্যতা থেকেই আসুক না কেন। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য। প্রাচ্যকে তিনি কোনভাবে ছোট চোখে দেখেননি। তাই বলা চলে তিনি ছিলেন একজন Whig - an English liberal. প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষার প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ দক্ষতা। তিনি প্রায় আঠাশটি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। তার মধ্যে গ্রীক, ল্যাটিন যেমন ছিল তেমনই ছিল পার্শি এবং সংস্কৃত ভাষাও। ১৭৬৮ সালে অক্সফোর্ড থেকে বিএ পাশ করার পর ডেনমার্কের রাজার অনুরোধে তিনি 'নাদির শাহের ইতিহাস' ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। A grammer of the Persian Language বলে একটা বইও লেখেন। তবে তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রাচ্যকে আরও ভালোভাবে জানা। সেই সুযোগ হয়ে যায় যখন বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁকে একটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের পদে নিযুক্ত করেন। ১৭৮৩ সালে জোন্স কোলকাতায় পদার্পন করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী অ্যানা মারিয়া। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করে দেন এশিয়াটিক সোসাইটির কাজ। প্রাচীন ভারতকে নতুন করে জানার প্রচেষ্টা।
তখন ইংল্যান্ড থেকে ভারতে জাহাজে করে আসতে লেগে যেত ছয়মাস। জাহাজে বসে বসেই তিনি ছক কষে নিয়েছিলেন কি কি কাজ করবেন ভারতে এসে। তাঁর সেই ‘to do list’ এ ছিল প্রাচীন ভারতের গণিত, বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন, শল্যবিদ্যার সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করা। তাঁর সেই স্বপ্নকে পূরণ করতেই শুরু করা এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন আজীবন। তাঁর এই সময়কালে বহু ভারত সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন তিনি। হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে গ্রীক, মিশরীয় সভ্যতার দেবদেবীদের অসম্ভব মিল সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন। সেইসব লেখা ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় হতে থাকে। নানান ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। সোসাইটি থেকে প্রকাশিত জার্নাল -‘Journal of the Asiatic Society of Bengal’ ছিল খুবই জনপ্রিয়।
ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে স্যার জোন্স যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই কাজ আমরা আজো সম্পূর্ন করে উঠতে পারিনি। আমাদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জেনে উঠতে পারিনি। মুছে গেছে কত ইতিহাস। আর কি ফিরবে সেই সব ইতিহাস? স্যার জোন্স ভেবেছিলেন কয়েক বছর ভারতে কাটিয়ে ফিরে যাবেন ইংল্যান্ডে। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয় নি। এই দেশের জল আবহাওয়া হয়ত তাঁর শরীরে সয় নি। ১৭৯৪ সালের ২৭ সে এপ্রিল, জোন্স দেহত্যাগ করেন। কোলকাতায়। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছিলেন না। স্ত্রী কিছুদিন আগেই পাড়ি দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড। ওল্ড পার্ক স্ট্রীট সিমেটরিতে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। এইরকমই এপ্রিলের এক দিনে। ঘর থেকে বহুদূরে। বিদেশে। ঠিক এমন ভাবেই হুগলীর রাধানগের রাজা রামমোহন রায়ও বহুদূর দেশে স্বজনহীন হয়ে ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেছেন। রামমোহন এবং জোন্স - দুইজনেই বাংলার নবজাগরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন বাঙ্গালী, একজন ইংরেজ। কিন্ত দুজনেই দেশ থেকে বহুদূরে মৃত্যুবরণ করলেন। ভাবতে অবাক লাগে।
***
এইসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম হয়ত আর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে মেল পাব না। স্যার উইলিয়াম জোন্সের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি হয়ত আর আগের মত নেই। যেমন আজকাল ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠানেরই অবক্ষয় ঘটেছে। ভাবলাম শ্রীধর আচার্যের গবেষণায় বেশ একটা ধাক্কা খাব। কিন্তু সুখের বিষয় আমায় ভুল প্রমাণিত হতে হল। সেইদিন সোসাইটির লাইব্রেরিয়ান ডক্টর প্রীতম গুরি মহাশয়ের থেকে একটা ইমেল আমার মেলবক্সে ঢুকল। অ্যাটাচমেন্টে দেখলাম - শ্রীধরের 'ন্যায়কুণ্ডলী' বইটি। খুশীতে আপ্লুত হয়ে গেলাম।
দেখি এই বইয়ে নতুন কিছু তথ্য আবিষ্কার করতে পারি কি না!
বলা হয় সাহিত্য সমাজের দর্পন। ভালো সিনেমাও অনেক সময় সমাজের দোষত্রুটি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু অঙ্ক? অঙ্কের প্রশ্ন কি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চিত্রাঙ্কন করতে পারে? মিত্র ইন্সটিটিউশনের সেই বিখ্যাত অঙ্ক বইয়ের লেখক কেশব নাগের কথা কেই না জানে! ছোটবেলায় নাগ মহাশয়ের গণিত বইয়ের প্রশ্নের খোঁচা খেতে অল্পবিস্তর সবাইকেই হয়েছে। চৌবাচ্চায় ফুটো দিয়ে জল পড়ছে। আর কেউ সেই পাত্রে জল ঢালার চেষ্টা করছে। কিংবা সেই বাঁদরটা, যে তেল মাখানো বাঁশে একটু উঠছে। আবার নামছে। অথবা ঘড়ির কাঁটা আসতে, জোরে চলছে। সেই সব অঙ্ক যেমন কঠিন ছিল। আজ মনে হয় বেশ মজাদারও ছিল। আর সেই সঙ্গে ফুটো চৌবাচ্চা, বাজে ঘড়ি কিংবা বাঁদরের কাণ্ডকারখানা সমাজের একখানা খণ্ডচিত্র তুলে ধরত। শ্রীধর আচার্যের ত্রিশতিকা বইয়েও এইরকম বেশ কিছু অঙ্ক রয়েছে। যেগুলো থেকে সেই অষ্টম-নবম শতাব্দীর অনেক কথা, সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, এমনকি চারপাশে কি রকমের গাছপালা ছিল, তাও বুঝতে পারা যায়। কিরকম?
শ্রীধর আচার্য এইরকম একটা অঙ্কের প্রশ্ন বানালেন - "একটি সুন্দরী রমণী মুক্তার হার পরেছিল। সুন্দরী তার প্রিয়তমের সাথে খুনসুটি করতে গিয়ে মুক্তার হারটি ছিঁড়ে ফেললেন। হারের এক পঞ্চমাংশ বিছানায় পড়ল। এক তৃতীয়াংশ পড়ল মাটিতে। এক ষষ্ঠাংশ মুক্তা রমণীর শরীরে। এক দশমাংশ মুক্তা তার সেই প্রেমিক খুঁজে পেলেন। তারপরেও ছটি মুক্তা সেই হারের সুতোয় ঝুলছিল। তাহলে, ও পণ্ডিত, এখন বলুন রমণীর হারে কয়টি মুক্তা ছিল?" অঙ্কটি সোজা। এক্স ধরে নিয়ে করলেই হয়ে যাবে। উত্তর হবে তিরিশটি। কিন্তু ভেবে দেখুন এই অঙ্কের মধ্য দিয়ে কত কিছু বোঝা যাচ্ছে। নারী পুরুষের প্রেমময় আলাপ। নারী নিশ্চয় খুব অভিজাত পরিবারের। তিরিশটি মুক্তাসম্বলিত হার পরেছে। আর তার সেই প্রিয়তম যে মুক্তার হার খুঁজতে মোটেই উৎসাহী নয়, তাও বোঝা যাচ্ছে। না হলে সে মোটে তিনটি মুক্তা খুঁজে পায়! পরে অন্য গণিতবিদ যেমন মহাবীর, বা শ্রীপতি এনারাও এই অঙ্কটি ধার নিয়েছেন।
তারপর ধরুন এই অঙ্কটা। -"একটা মৌমাছির ঝাঁক ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। ঝাঁকের এক ষষ্ঠাংশ পাটালি গাছে ঘুরছিল, এক তৃতীয়াংশ কদম গাছে, এক চতুর্থাংশ আম গাছে, এক পঞ্চমাংশ চাঁপা গাছে আছে। সূর্যের কিরণে একটা পদ্ম পূর্ন প্রস্ফুটিত হল। তাতে ঝাঁকের এক ত্রিশাংশ এসে হাজির হল। কেবল একটা মৌমাছি মধু খেয়ে পাগল হয়ে আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাহলে বল, এই মৌমাছির ঝাঁকে কতগুলি মৌমাছি ছিল?" রমণীর মুক্তার হারের মত একই ধাঁচের অঙ্ক। কিন্তু অঙ্কটি বেশ সুন্দর কবিতার মত। গাছপালা, ফুল, মৌমাছি, মধু। তার ওপর জানা গেল সেই সময় কি কি গাছ সাধারণত দেখা যেত। আম, চাঁপা, কদম যে তখনও ছিল। তা পরিষ্কার হল। তবে পাটালি গাছটি কি তা জানি না। কেউ জানলে বলবেন।
এইরকম হাতির পালেরও একটা অঙ্ক আছে। পালের কিছু হাতি পাহাড়ে, কিছু জল নিয়ে, কতকগুলি পদ্মফুল নিয়ে আর একটি হাতি তিনটি মেয়ে হাতির সাথে খেলা করছিল। তাহলে হাতির পালে কটা হাতি? আবার একটা লোক বাজার করতে গিয়েছিল। গিয়ে দেখল আধ পলা হিং, দু পলা লঙ্কা, আর সাত পলা শুকনো আদার দাম ছিল একটি রৌপ্য মুদ্রা। লোকটি তখন একটি রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে বলল - আমায় হিং, লঙ্কা আর আদা সমান অনুপাতে দিন। তাহলে দোকানদার কিভাবে দেবে? বুঝুন ঠ্যালা! দোকানদারকে বেশ ভালো রকমের একটা অঙ্ক কষতে হবে। তবে আমার জানতে ইচ্ছা করে লোকটির বাড়িতে এইসব মশলা দিয়ে সেদিন কি রান্না হতে চলেছে? মাংস?
শ্রীধর আচার্যের 'ত্রিশতিকা' বইয়ের পাতায় এইরকমের অঙ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কখনো তিনি 'খাদিরা' গাছের তক্তার বেধ মাপছেন, কখনো বা মাটির নিচে শস্য জমা করার জন্য একটা গুদাম ঘরের আয়তন নিয়ে মাপজোখ করছেন, কখনও একটা আলসী লোক লম্বা রাস্তা হেঁটে যাচ্ছে তার পথের দৈর্ঘ্য হিসাব করে দিচ্ছেন। কখনোও বা রমণীর মুক্তার হার, হাতির পাল আর মোমাছির ঝাঁক নিয়ে মেতেছেন। এতো অঙ্কের জগত নয়। এ যেন জগতের অঙ্ক!
প্রায় অনেকদিন পর শ্রীধর আচার্য নিয়ে আবার লিখছি। আজ গবেষণায় একটা নতুন এবং গুরুত্ত্বপূর্ন মোড় এল।
আচার্যের খোঁজ করতে একেবারে প্রথমের দিকে ডিহিভুরসুটের অবসরপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান সুশান্ত ভারতীর সাথে আমার কিছু কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন ১৯৯৭ সালে দিল্লি থেকে রজত চক্রবর্তী নামে একজন জায়গাটা খনন করতে এসেছিলেন। কিছু জিনিসপত্র খুঁড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কার্বন ডেটিং এর জন্য। সুশান্তবাবু যতদূর মনে করতে পেরেছিলেন রজতবাবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। তবে আমি অনেক চেষ্টা করেও রজতবাবুর খোঁজ পাইনি। তাই আশা প্রায় একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবেই সেদিন একটা ই-মেল পেলাম।
ইমেইলটি লিখেছিলেন জনৈক সোহম ভারতী। তিনি জানিয়েছিলেন আমার সাথে কথা বলতে চান। সম্ভবত আচার্য নিয়ে গবেষণায় আমায় কিছু সাহায্য করতে চান। আমি আমার নাম্বারটা ওনার সাথে শেয়ার করলাম। পরের দিনই ফোনে মেসেজ এল। মেসেজ পড়ে বুঝতে পারলাম সোহম আসলে শান্তনীড় পাঠাগারের গ্রন্থগারিক সুশান্ত ভারতীরই সুপুত্র। ঘটনাচক্রে সোহম আর আমি মাধ্যমিকে একই ব্যাচের ছাত্র। সোহমের কথা থেকেই জানলাম বহু আগে, মানে স্কুলজীবনে আমাদের একবার দেখাও হয়েছিল। তবে আমার মনে ছিল না। আমরা কাছাকাছি জায়গার এবং বয়সে সমান হওয়ার তাগিদে বেশ কতকগুলি কমন ফ্রেন্ডও আছে আমাদের। সেই ২০০৬ সালে সরস্বতী পুজোয় দেখা হবার পর দুজনের সাথে আর দেখা হয়নি। জীবন অনেক দূর গড়িয়েছে দুজনেরই। কথা হল প্রায় আঠারো বছর পর।
যাইহোক, এই সব স্মৃতিমেদুরতার পর, সোহমের সাথে আসল কথায় ফিরে আসা গেল। শ্রীধর আচার্যের কথায়। আমি এই নিয়ে লেখালেখি করছে জেনে খুব খুশি হল। তাঁর সাথে কথা বলে জানলাম সে আমার ইতিমধ্যে প্রকাশিত লেখাগুলো আগাগোড়া পড়েছে। সোহম জানাল - তার বাবা রজতবাবু সম্পর্কে বলতে তিনটি ভুল তথ্য বলেছিলেন। প্রথম - যিনি ডিহুভুরসুটে খননকার্যে এসেছিলেন তাঁর আসল নাম ছিল রজত সান্যাল, রজত চক্রবর্তী নয়। দ্বিতীয় - রজত সান্যাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন। তিনি বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে কর্মরত। ওখানকার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। সোহম এই খবরগুলো পেয়েছিল ওরই এক জ্যাঠাতুতো দাদা বিশ্বনাথ ভারতীর থেকে। সম্ভবত বিশ্বনাথবাবু রজত সান্যালের বন্ধুস্থানীয় এবং সমবয়সী। আর তৃতীয় ভুলটি হল - রজত সান্যাল খনন কার্যটি করিয়েছিলেন ২০০২ সালে। ১৯৯৭ সালে নয়। সোহম জানাল তখন সে শ্যামপুর হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ত। ছোট্ট সোহমও সক্রিয়ভাবে এই খননকার্যে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি ডিটেইলস তার জানা নেই।
বলা বাহুল্য, এই তথ্যগুলো পেয়ে আমি বেশ আনন্দিত হলাম। বেশ ভালো করে বুঝতে পারলাম কেন আমি আগে রজত চক্রবর্তীর খোঁজ পাইনি। আমরা আসলে ভুল লোককেই খোঁজ করছিলাম। ইন্টারনেটে রজত সান্যালের প্রোফাইল খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। রজতবাবু ২০০৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরকিওলজিতে পি এইচ ডি করেছেন। Indian National Science Academy, British Academy, University Grants Commission (Govt. of India), European Research Council, The Asiatic Society (Kolkata) ইত্যাদি সংস্থাগুলো থেকে তিনি তহবিলও পেয়েছেন প্রাচীন বাংলা এবং পূর্বভারতের প্রাগৈতিহাসিক জায়গাগুলো নিয়ে গবেষণা করার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলির খননকার্যের সাথেও তিনি জড়িত। কিছুবছর আগে তিনি একটা প্রজেক্টের কাজে বিলেতও ঘুরে এসেছেন। Queens University, Belfast. আমি ভাবলাম, বা! রজতবাবুই আমাদের এই শ্রীধর আচার্যের কাজে অনেক সাহায্য করতে পারেন। খুব শীঘ্রই ওনার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সোহমই নাম্বারটা দিয়েছিল রজতবাবুর। বলল - আগে থেকে জানিয়ে রাখবে আমার কথা।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার ছুটি। সন্ধ্যের দিকে রজতবাবুকে ফোন করলাম। গলাটা শুনে বেশ আন্তরিক লাগল। বললেন - 'ও, আচ্ছা, প্রেমাশিস বাবু? সোহম আপনার কথা আমায় বলেছে। আমি আপনার মেসেজের রিপ্লাই করতে পারিনি। সেজন্য দুঃখিত। আসলে বেশ কদিন ধরে দাঁতের ব্যাথায় ভুগছি। আজ এখনই স্নান করে ইউনিভার্সিটিতে ছুটতে হবে। কাল কল করি?'
১৪ ই আষাঢ়, ১৪৩০
রেহভত, ইজরায়েল
তারপর থেকে রজতবাবু আমাকে আর কল করেননি। আমারও কটা দিন ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছিল। সুতরাং আচার্য নিয়ে ভাবার অবকাশ হয় নি। দুদিন আগে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। মনে হল রজতবাবুকে একবার কল করি। কি জানি উনি বোধ হয় কাজের চাপে ভুলে যেতেও পারেন।
তখন বিকেল। চারিদিকে কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল জগতটাকে যেন ভরিয়ে রেখেছে। সামনেই একটা বুড়ো বটের গাছ। বড় বড় ঝুড়ি নেমে এসেছে সেখান থেকে। দু একটা শালিক গাছের নিচে পড়ে থাকা বটফল কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছে। গাছের নিচে একটা কাঠের বেঞ্চ। আমি বেঞ্চে বসে রজতবাবুকে ফোনটা করলাম। দু এক বার রিং হবার পর রজতবাবু ফোনটা তুললেন -"সরি প্রেমাশিস বাবু, আমি খুবই দুঃখিত। এই কভিডের পরে আমাদের যা চাপ পড়েছে। একেবারে নাজেহাল অবস্থা। তার ওপরে শরীরটাও..." আরও কিছুক্ষণ কুশল বিনিময়ের পর আসল কথায় ফিরে আসা গেল। উনি বললেন -"আচ্ছা আপনি আমার কাছ থেকে এক্সাক্টলি কি জানতে চাইছেন, সেটা বলবেন?"
আমি বললাম - "আমি শুনেছি ওই ডিহিভুরসুটের আচার্য বেড় জায়গাটায় আপনি একবার খনন করেছিলেন। সেখান থেকে যদি কোন ইনফরমেশন পেয়ে থাকেন, বলবেন? আসলে আমি শ্রীধর আচার্য নিয়ে একটু লেখালিখি করছি। কিছু বইয়ে, যেমন নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাসে’পড়েছি যে অতীতের 'ভূরিশ্রেষ্ঠী' নামক গ্রামে শ্রীধর আচার্য নাকি জন্মেছিলেন। সেই গ্রাম আজকের ডিহিভুরসুট গ্রামটি হতে পারে। আপনি কি এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন? "
রজত বাবু বললেন - "দেখুন, এটা ঠিক আমি অতীতে একবার ডিহিভুরসুটে খনন করেছিলাম। কিন্তু সে প্রপার খনন ছিল না। জানেনই তো, কোন জায়গা খনন করতে হলে আমাদের অনেক ভেবে চিন্তে করতে হয়। তবে আমি সেইসময় শ্রীধর আচার্য নিয়ে খুব একটা ইন্টারেস্টেড ছিলাম না। আমি এই এলাকার প্রাচীন জনপদ নিয়ে গবেষণা করছিলাম। যা কিছু পেয়েছিলাম, সেখান থেকে মনে হয়েছিল এই ডিহিভুরসুট বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় মোটামুটি হাজার সাল আগে থেকে মানুষ বসবাস করছে। এর থেকে বেশি আমি আপানকে সাহায্য করতে পারলাম না।"
শুনে একটু নিরাশই হলাম। কিন্তু কিই বা আর করার আছে। তবে রজতবাবুর থেকে এটুকু জানা গেল বহু প্রাচীনকালে এই জায়গাটায় বেশ রমরমা ছিল। কিছুদিন আগে সোহমের সাথেও এই নিয়ে কথা হয়েছিল। বন্ধু সোহমেরও যে কারণে এই স্থানটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক বলে মনে হয়, সেটি হল -
"
১. গত শতাব্দীর সাতের দশকে ডিহিভূরশুট বোর্ড প্রাইমারী স্কুল (লোকমুখে, শিবতলা প্রাইমারী স্কুল)-এর একটি পাকা ভবন নির্মাণের সময় যখন ভিত খোঁড়ার কাজ চলছিল তখন স্কুল বাড়িটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে একটি ভগ্নপ্রায় স্তম্ভের একাংশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন সময়ে নির্মীয়মাণ ভবনটির ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা আরো প্রকট হয়ে নির্মাণকাজ থেমে যাওয়ার আশঙ্কায় ওই নির্মাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ বিষয়টি জনমানসে ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ার আগেই অত্যন্ত তৎপরতার সাথে ভবনটির ওই অংশের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। ওঁদের পরিকল্পনা মাফিক পরবর্তীতে বিষয়টা ধামা চাপা পড়ে যায়।
২. আটের দশকের শেষ অথবা ন'য়ের দশকের গোড়ায় ডিহিভূরশুট বাসস্ট্যান্ড থেকে কৃষ্ণদের বাড়ি আসার পথে 'সামুই পাড়ায় ঢোকার রাস্তার পাশে একটি ডোবা' সংস্কার করতে গিয়ে ওখানকার ভূমির সমতলের প্রায় সাড়ে তিন চার ফুট নীচে করাত দিয়ে মসৃণভাবে কাটা এক বা একাধিক গাছের গুঁড়ির ঠিক শিকড়ের ওপরের অবশিষ্টাংশ নজরে আসে।
৩. অধুনা ডিহিভূরশুট শান্তনীড় পাঠাগারের ঠিক পিছনে বহু শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরের এক ধ্বংসাবশেষ ছিল। বর্তমানে ওই স্থানটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার কারণে ভূমির উপরিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইট পাথরের টুকরোগুলো পর্যন্ত মালিকানাধীন পরিবারের সংশ্লিষ্ট মানুষজন একদম সাফসুতরো করে নিয়ে চলে গেছে। ২০০০ সালের সমসাময়িক সময় পর্যন্ত ওই মন্দিরের ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে বারে বারে বিভিন্ন গুজব রটেছে। এই এলাকার আমাদের সমসাময়িক বা আমাদের থেকে বড়ো যেকেউই অন্ততঃ এই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত।
৪. ২০০২-এ রজতদা'র নেতৃত্বে আচার্য্য বেড়ের একটি অংশে মাটি খোঁড়ার সময় কয়েকটি স্তরে বিভিন্নরকম পোড়ামাটির টুকরোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সাধারণ দৃষ্টিতেই পোড়া মাটির পাত্রের টুকরোগুলো থেকে ধারণা করা যায় পাত্রগুলো সব একই সময়ে নির্মিত নয়।"
সোহমের এইসব তথ্য থেকে থেকে আমার ধারণা যে গণিতজ্ঞ বা দার্শনিক এই দুই শ্রীধর আচার্যের কেউ একজন এই জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও অকাট্য প্রমাণ লাগবে। সেই প্রমাণের খোঁজ যথাসম্ভব চালিয়ে যাব। দেখি কতদূর যেতে পারি।
যাইহোক, রজত বাবুর সাথে আমার কথা বলে বেশ ভালো লেগেছিল। আমার এই শ্রীধর আচার্যের খোঁজে উনি বিশেষ সাহায্য করতে পারলেন না বলে আক্ষেপ করেছিলেন। তবে আমার এই প্রচেষ্টাকে বেশ সাধুবাদও জানালেন। উনিও হুগলীর লোক। আমি আমেরিকায় অধ্যাপনা করতে যাচ্ছি শুনে বিশেষ খুশী হলেন। কথাপ্রসঙ্গে উঠে এল উনি এখন বীরভূম জেলা নিয়ে কাজ করছেন। পরে নদীয়ায় কাজ করার ইচ্ছা আছে। শেষ বয়সে সুযোগ পেলে আবার হুগলীতে কাজ করবেন।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। এখানে মশার বেশ উৎপাত। দু চারটে অ্যানোফিলিস ধরলে আর রক্ষা নেই। আমি অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
২৭ শে আষাঢ়, ১৪৩১
রেহভত, ইজরায়েল
Copyright © 2024 Manna Laboratory - All Rights Reserved.
Powered by GoDaddy
We use cookies to analyze website traffic and optimize your website experience. By accepting our use of cookies, your data will be aggregated with all other user data.